অনিচ্ছায় রাতে বিছানায় প্রস্রাব করাকে বেডওয়েটিং বলা হয়। পাঁচ ঊর্ধ্ব শিশুদের ক্ষেত্রে এটিকে মেডিকেলের ভাষায় নকচারনাল এনুরেসিস বলে। রোগটি শিশুর মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ২৫ শিশুর চারজনই বেডওয়েটিং করে। গড়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিশুর সমস্যাটি বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে কৈশোর পর্যন্ত থেকে যায়। স্বল্প ব্লাডার ধারণক্ষমতা বেডওয়েটিংয়ের জন্য দায়ী। ঘুম থেকে জাগতে না পারাও এ রোগটির অন্যতম কারণ।

বেডওয়েটিং কেন হয়

> শিশুদের রাত্রিকালীন প্রস্রাবের কোনো সুস্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে জন্মগত বা বংশগত প্রস্রাবের থলির স্প্রিন্টারের অপরিপক্বতা বা ঢিলার কারণে হয়। মা-বাবা শৈশবে এ ধরনের রোগে ভুগে থাকলে, তাদের সন্তানেরও এটি হওয়ার সম্ভাবনা ৭৫ শতাংশ। পারিবারিক ইতিহাস না থাকলে ১৫ শতাংশ আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে।

> মানসিক টেনশন, যেমন—স্কুলের পড়াশোনার চাপে বিছানা ভেজানোর সমস্যা বেশি দেখা যায়। ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রস্রাবে সংক্রমণ ও প্রদাহ দায়ী।

> মূত্রথলি ছোট হলে রাতে প্রস্রাব ধরে রাখার সক্ষমতা থাকে না। মূত্রথলি নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলোর পরিণত হওয়ার গতি ধীর হলেও এ সমস্যা হতে পারে।

> হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে দেহে পর্যাপ্ত অ্যান্টি-ডিউরেটিক হরমোন (ADH) উৎপাদন করে না। তখন বেডওয়েটিংয়ের সমস্যা হয়।

> কখনো কখনো নিদ্রাহীনতা বা ঘুমের ব্যাঘাতের কারণেও হতে পারে।

> যে শিশু সাধারণত রাতে বিছানায় প্রস্রাব করে না, তার ক্ষেত্রে এমন হলে ডায়াবেটিসের প্রথম লক্ষণ হতে পারে। অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া, তৃষ্ণা বৃদ্ধি, ক্লান্তি এবং ওজন হ্রাস অথচ ক্ষুধা থাকতে পারে।

> কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘমেয়াদি হলে মূত্র ও মল নিয়ন্ত্রণ পেশিগুলো অকার্যকর হয়ে উঠতে পারে এবং বেডওয়েটিং হতে পারে।

> চাপ ও উদ্বেগজনিত যেমন—বড় ভাই বা বোন হওয়া, নতুন স্কুল শুরু করা বা বাড়ির বাইরে রাতে ঘুমানো ইত্যাদি বেডওয়েটিংয়ের কারণ হতে পারে।

> মনোযোগে ঘাটতি, হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) বা অতি চঞ্চলতা শিশুর মধ্যে থাকলে, তাদের বিছানা ভেজানোর সমস্যা বেশি দেখা যায়।

 

শিশুর ওপর প্রভাব
> বেডওয়েটিং করে এমন শিশু নিয়ে অভিভাবকরা বেড়াতে বিব্রতবোধ করেন।

> রাতের ভ্রমণে অস্বস্তিতে থাকেন অভিভাবকরা।

> ভাই-বোন কিংবা বন্ধুবান্ধব কেউই তার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাতে চায় না।

> কারণে অকারণে শিশুটিকে অন্যরা লজ্জা দেয়।

> এভাবে বেডওয়েটিং একটি শিশুর আত্মসম্মান, মানসিকতা ও দৈনন্দিন জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এ প্রভাবকে সঠিক মূল্যায়ন না করায় প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।

> মাঝেমধ্যে অভিভাবকরা বেডওয়েটিংয়ের জন্য সন্তানকে বকাঝকা করেন। এটি তার মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে।

বেডওয়েটিং দূরে করণীয়
> অনেকেই ভাবেন, বেডওয়েটিং এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বেডওয়েটিং একটি জটিল সমস্যা যা চিকিৎসা ছাড়া ঠিক হবে না। সফল চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুর মানসিক চাপ দূর করে তার দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা উন্নত করা সম্ভব।

> আর্দ্রতা অ্যালার্ম এবং কখনো কখনো ওষুধ বিছানায় প্রস্রাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ খুব জরুরি। শুরুতে মা-বাবা শিশুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে হবে। শিশুকে যেন শাস্তি দেওয়া না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করতে হবে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

> ঘুমের আগে অতিরিক্ত পানি পান করা উচিত নয়। ঘুমের পর তিন ঘণ্টার মধ্যে সাধারণত বিছানা ভেজায়। তাই এ সময় শিশুকে জাগিয়ে বিছানায় প্রস্রাব পরিহার করানো যায়। যেদিন শিশু বিছানা শুকনো রাখবে, সেদিন প্রশংসা বা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে হবে। বকা দেওয়া যাবে না।

> ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন—চা, কফি ইত্যাদি সন্ধ্যার পর পরিহার করতে হবে।

> সন্ধ্যায় তরলজাতীয় খাবার সীমিত রাখতে হবে। তবে পর্যাপ্ত তরল পান করাও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ। শিশু দিনে কী পরিমাণ পানীয় পান করবে, তা ঠিক রাখতে হবে। তবে এটি সকাল ও বিকেলে পানের জন্য তাকে উৎসাহ দিতে হবে। সন্ধ্যায় হ্রাস করতে পারে। কোনো শিশু সন্ধ্যায় খেলাধুলা করলে, তার ক্ষেত্রে সন্ধ্যায় তরলজাতীয় খাবার সীমাবদ্ধ করা ঠিক হবে না।

> ঘুমানোর আগে দুবার প্রস্রাব করাতে হবে। শোবার শুরুতে এবং ঘুমের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রস্রাব করাতে হবে। এমনকি ঘুম থেকে উঠে মাঝরাতে আরেকবার প্রস্রাব করানোর অভ্যাস করলে ভালো হয়। ঘরে ডিম বা নাইট লাইট ব্যবহার করুন, যাতে শিশু খুব সহজেই শোবার ঘর এবং বাথরুমে যেতে পারে।

> অন্যান্য চিকিৎসার আগে বিছানায় প্রস্রাব করার কিছু কারণ যেমন- কোষ্ঠকাঠিন্য বা স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে তার চিকিৎসা করাতে হবে।

> অক্সিটেনিন (ডাইট্রোপানএক্সএল) মূত্রাশয়ের সংকোচনের পরিমাণ হ্রাস করতে এবং মূত্রাশয়ের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। দিনের বেলাতেও শিশুর বেডওয়েটিং হলে চিকিৎসকের পরামর্শে এ ধরনের ওষুধ ভালো উপকারী।

 

লেখক:

ডা. নাজমা পারভিন শাম্মী

শিশু বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক
উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.