সমাজে যে অংশের নারীরা জরায়ুমুখের ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে রোগটি নিয়ে সচেতনতার অভাব প্রচণ্ড। লজ্জা-সংকোচ তাদের বিরত রাখে পরীক্ষা- নিরীক্ষা ও চিকিৎসামুখি হতে। নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থাও বড় বাধা। স্তন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতাও এগিয়ে নেওয়া দরকার।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রতি বছর ৬ লাখের বেশি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ মারা যান। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে নারী ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের পরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জরায়ুমুখ ক্যান্সার। প্রতিবছর এদেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে ৮ হাজারের বেশি নারী আক্রান্ত হয়, নারীদের ক্যান্সারের প্রায় ১২ শতাংশ। মারা যায় ৪ হাজার ৯৭১ জন।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৭ সালের হাসপাতাল-ভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীদের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের স্থান দ্বিতীয় (১৫.৯ শতাংশ), স্তন ক্যান্সার শীর্ষে (৩১.১)। নারী- পুরুষ নির্বিশেষে এর অবস্থান চার নম্বরে (৭.৫)। সহজভাবে বলা যায়, প্রতি পাঁচ নারী ক্যান্সার রোগীর একজন জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত।

জরায়ুমুখ ক্যান্সার কি
মায়ের পেটে জরায়ু বা ইউটেরাস নামক অঙ্গটির ভেতরে আমরা প্রত্যেক মানুষ জন্ম নেই। এই জরায়ুর নিচের দিকে সরু অংশ জরায়ুমুখে ক্যান্সারকে সারভাইক্যাল বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার বলা হয়। পুরো জরায়ু থেকে জরায়ুমুখের ক্যান্সার একটু ভিন্ন প্রকৃতির।

কেন হয় জরায়ুমুখের ক্যান্সার
আক্রান্ত হওয়ার পেছনে কতগুলো আর্থ-সামাজিক ও ব্যক্তিগত কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে আমরা প্রধানত দায়ী করি বাল্যবিয়েকে। খুব অল্প বয়সে বিয়ে, সন্তানধারণ, ঘনঘন ও বেশি সন্তান হলে, জরায়ুমুখের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব, বিশেষ করে মাসিকের সময় জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় না রাখা ও অপুষ্টি।

জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা। আরও স্পষ্ট করলে একাধিক সঙ্গীর সিঙ্গে শারীরিক মেলামেশা। আমাদের দেশে সমস্যাটি বাড়ছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এ হার বেশি। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) ভাইরাসকে বলা যায়, প্রধান কালপ্রিট। এ ভাইরাসের সংক্রমণ বারবার হলে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে মূলত এ ভাইরাস ছড়ায়। একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশা বয়ে আনতে পারে নারীর জন্য ভয়াবহ বিপদ । বিপথগামী স্বামী কিংবা পুরুষ সঙ্গীর কারণে একজন নারী আক্রান্ত হতে পারে । এছাড়া এইচপিভি ভাইরাসের কারণে শরীরের অন্যান্য অংশেও সংক্রমণ হয়।

জরায়ুমুখের ক্যান্সার হলে যে সমস্যা হয়
মাসিকের রাস্তায় অতিরিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব যাওয়া, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি কয়েক রকম হতে পারে। যেমন: প্রতিমাসে নারীদের মাসিকের সময়কাল হঠাৎ বেড়ে যায়, বেশি পরিমাণে রক্ত যাওয়া শুরু হয়। মাসের মাঝখানে এ রকম রক্তক্ষরণ হয়। স্বাভাবিক নিয়মে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্বামী- স্ত্রীর মিলনের পর রক্তক্ষরণ হয় বা ব্যথা হয়। তবে রোগটি আরেকটু অগ্রসর হয়ে আশপাশের অঙ্গ-পতঙ্গ আক্রান্ত করে, তখন ধীরে ধীরে আরও কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন: তলপেটে ব্যথা, প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রক্ত যেতে পারে।

উপরের লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়া মাত্রই রোগীকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। পরামর্শ ও পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগ নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসায় ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ আশাবাদের জায়গা আছে। আমরা জানি, কোষের মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে এক পর্যায়ে ক্যান্সার হয়। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ বছর পর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে পূর্ণাঙ্গ বা আগ্রাসী ক্যান্সারে রূপ নিতে।

এ জন্য লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই এ ক্যান্সার আমরা নির্ণয় করতে পারি। এখানে দুটো প্রধান পরীক্ষা রয়েছে। প্যাপটেস্ট, যাকে গোল্ডস্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়। আরেকটি হলো ভায়া টেস্টের মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। পরীক্ষা দুটি নিয়ে আতঙ্ক বা ভয়-ভীতির কিছু নেই। এটা কাঁটা-ছেড়া বা কষ্টদায়ক পরীক্ষা নয়। একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ যেভাবে নারী রোগীকে পরীক্ষা করেন, অনেকটা সে রকম।

চিকিৎসায় করণীয়
চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবাই মিলে বসে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি নাকি রেডিওথেরাপি। সাধারণত চারটি পর্যায়ে রোগের অবস্থাকে ভাগ করা হয়-  ১, ২, ৩ ও ৪। এর মধ্যে আবার এ, বি-এভাবে ভাগ করা হয়। স্টেজ বা পর্যায়-২ পর্যন্ত থাকে, তখন প্রধান চিকিৎসা হলো অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়া। পরে অন্যান্য চিকিৎসা লাগে সেগুলো করা। এ চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দেরি হলে গেলে বা ওই পর্যায়টি পার হলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার করা যায় না। রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি দিয়ে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার পর, অনেক ক্ষেত্রে আবার অস্ত্রোপচারের দিকে যাওয়া যায়। যত আগে ধরা পড়বে, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এ রোগে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে এসব বিষয়ে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

সংকোচের বিহ্বলতা কাটাতে হবে। আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয় মাথায় রেখে প্রাণঘাতী এ রোগটি নিয়ে আলোচনা করাটাও অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য। অনেকে ভিতরে ভিতরে রোগটি পুষতে থাকেন। লক্ষণ টের পেলেও পরিবারের সদস্যদের কাছে গোপন রাখেন। শেষ পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য আসেন, কিন্তু করার কিছুই থাকে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

নারীদের প্রধান দুটি ক্যান্সারের স্থান অর্থাৎ স্তন ও জরায়ুর সুস্থতা নিয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। নারীদের বুঝতে হবে স্তন কিংবা জরায়ু একজন নারীর জন্য, একজন মায়ের জন্য লজ্জা বা সংকোচের বিষয় নয়। যে অঙ্গে মা তার সন্তান ধারণ করেন, সেই জরায়ু, কিংবা জন্মের পর যে অঙ্গ থেকে সন্তানকে পুষ্টি যোগান, সেই স্তন বরং একজন মায়ের জন্য অহংকারের বিষয়। এর সুস্থতা নিয়ে নারীকে কথা বলার সাহস যোগাতে হবে। প্রত্যেক পুরুষের দায়িত্ব জননীর, নিজের কিংবা তার সন্তানের জরায়ুর সুস্থতা নিশ্চিত করা। জননীর কাছে জন্মঋণ স্মরণ করে।

 

লেখক:

অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন

নির্বাহী পরিচালক, সিসিইপিআর

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.