ঢামেক বহির্বিভাগ কিংবা সান্ধ্যকালীন এডমিশন ডিউটি অথবা চেম্বার-
এমন কোন নাক কান গলার ডাক্তার মিলবে না, যিনি এমন রোগী পাননি- যিনি এসে বলেছেন,
“ডাক্তার সাব আমার নাকে পলিপ, নাক বন্ধ থাকে, পানি ঝরে, মাথা ব্যাথা, বমি লাগে, নাক চুলকায় ইত্যাদি।”

শতকরা ৯০% ভাগ রোগীর চিহ্নিত কম্পলেইনটি ছাড়া বাকিগুলা সত্যি।

ন্যাসাল স্প্যাকুলাম বা কিলিয়ান্স দিয়ে নাক দেখতে গিয়ে আমরা দেখি রোগীর ভাষ্যমতে যাহা পলিপ উহা আসলে পলিপ নহে। উহা নাকের ইনফিরিয়র টার্বিনেট হাইপারট্রপি, যার আদুরে নাম HIT.

তবে সত্যিকারের নাকে পলিপের সমস্যায়  অনেকেই ভুগে থাকেন। কিছু পলিপ শিশু অবস্থায় এই সমস্যা দেখা দেয়। আবার পূর্নাঙ্গ বয়সেও পলিপ থেকে যায় কারো কারো।  শীতকালে পলিপ সমস্যাটি সবচে বেশি ভোগায়। এতে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কারণ পলিপ নাকের স্পেস একদমই কমায় দেয়। ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে পলিপ। কর্টিসল হরমোন এক্টিভেট হয়।আরো নানাবিধ কারণসহ এই কারণে ও তাই শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ কম হয়। নাকের আশপাশে কিছু প্রকোষ্ঠ বা ফাঁক জায়গা (সাইনাস) আছে।  চোখের ঠিক নিচে যে উঁচু হাড়টি আছে তার ভেতরে ফাঁকা জায়গাটি ম্যাক্সিলারি সাইনাস, নাক আর চোখের মাঝখানে যে ক্ষুদ্র ফাঁকা স্থান সেখানে থাকে বেশ কয়েকটি ওগুলা ইথময়েড সাইনাস।  কপালের সম্মুখভাগে থাকে ফ্রন্টাল সাইনাস।

চোখের পেছন দিকে থাকে স্ফেনয়েড সাইনাস ।

এ সাইনাসগুলোর আবরণ অনেক সময় ফুলতে ফুলতে আঙ্গুরের থোকার মতো আকার ধারণ করে।  একেই আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় পলিপ বলে থাকি। এই পলিপ নাক একপাশে (ম্যাক্সিলারি) বা দুইপাশে ও (ইথময়েড) থাকতে পারে।

নাকের ভেতর ছত্রাক সংক্রমন দ্বারা নাকের উভয় দিকে এবং এ ক্ষেত্রে একাধিক সাইনাস পলিপ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এ পলিপগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে সাইনাসের ভেতর থাকে।

এক সময় এটা বাড়তে বাড়তে সাইনাস থেকে নাকের ভেতরে চলে আসে এবং তখন আমরা খালি চোখেও নাকের ভেতরে পলিপ দেখতে পাই।  অনেক সময় পলিপে ইনফেকশন হলে বা আঘাতজনিত কারণে এর ত্বকের স্তর মিউকোসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় এটা লালচে রঙ ধারণ করতে পারে।

উপসর্গ :

★ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীরা সাধারণত নাক দিয়ে সর্দি ঝরা, নাক বন্ধ ভাব এ ধরনের সমস্যায় ভোগেন। গলায় খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার না করলে অস্বস্তি অনুভূত হয়, ঢোক গিলা বা গলা পরিষ্কার করার মতো প্রবণতা দেখা যায়।

অসুখ যত বাড়তে থাকে ততই দেখা যায় ধীরে ধীরে দুটো নাকই বন্ধ হয়ে যায়, নাকের ভেতরের জায়গা দখল হয়ে যাওয়ায়। প্রথমে আংশিকভাবে এবং পরে সম্পূর্ণভাবে নাক বন্ধ হয়।

★ হাঁচি থাকতে পারে এবং অল্প ধুলাবালি বা ধোঁয়াতে গেলেই প্রচণ্ড হাঁচি হতে থাকে। সিগারেটের বা রান্নার ধোঁয়া সহ্য হয় না। দম বন্ধ ভাব চলে আসে।

★ পলিপের কারণে মাথাব্যথা সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পলিপ যখন বেশ বড় আকার ধারণ করে তখন মাথাব্যথা চলে যায়। এর কারণ যে অবস্থাতে আমরা পলিপ দেখতে পাই সে অবস্থাতে মাথা ব্যথার সমস্যা সাধারণত থাকে না। মাথা এবং কপালের সম্মুখ বা নাক এবং এর আশপাশে একটা বন্ধ ভাব থাকতে পারে।

★ নাকের ঘ্রাণশক্তি কমে যায় এবং অনেক সময় ইনফেকশনের কারণে নাকে পূজ হয়, দুর্গন্ধ পাওয়া যায়।

★ নাক ছাড়াও পলিপের কারণ কান আক্রান্ত হতে পারে। আমরা জানি নাকের পেছনে কানের ইউস্টেশিয়ান টিউব থাকে। নাকের ইনফেকশন ন্যাসোফ্যারিংক্সের মিডিয়ালি থাকা ইউস্থেশিয়ান টিউবকে আক্রান্ত করে, যা হওয়ার কারণে অনেক সময় মধ্য কর্ণে সমস্যা হয়ে থাকে। কান বন্ধ বন্ধ ভাব বা কানের ভেতর পানি যাওয়ার কারণে কান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।কানের ভেতরে শোঁ শোঁ আওয়াজের সমস্যাও হতে পারে। কানের ভেতরে অনেক দিন পানি জমে থাকলে কানের পর্দা নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদে কান পাকা রোগের সৃষ্টি হতে পারে।

★কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাথা ঘুরানোর সমস্যাও থাকতে পারে। মধ্যকর্ণের এ সমস্যা থেকে অল্প-স্বল্প মাথা ঘুরানোভাব থেকে শুরু করে মারাত্মক রকমের মাথা ঘুরানোর সমস্যা থাকতে পারে.

চিকিৎসা 

প্রাথমিক চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো রোগীকে কনফার্ম করা এটা নাকের ক্যান্সার নয়। তবে দীর্ঘদিন পলিপ চিকিৎসা না করলে কিংবা নিয়মিত সেখানে ইনফেকশন হতে থাকলে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে নাকে স্টেরয়েড জাতীয় স্প্রে ব্যবহার করলে এটা চলে যেতে পারে।

পলিপ যদি নাককে সম্পূর্ণ অথবা আংশিকরূপে বন্ধ করে দেয় তাহলে সাধারণত ওষুধে কাজ হতে চায় না। এরকম ক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে পলিপ ফেলে দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

আধুনিক এ যুগে পলিপের সর্বশেষ এবং সর্বাধুনিক চিকিৎসা হল- রোগীকে অজ্ঞান করে এন্ডোস্কোপের মাধ্যমে পলিপগুলো মূল শিকড় সহ উতপত্তিস্থল থেকে অর্থাৎ সাইনাসের যে আবরণী যেখান থেকে পলিপ উৎপত্তি হয় সেখান থেকে সম্পূর্ণরূপে ফেলে দেওয়া।

এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে আমরা অতি  যে কোনো সাইনাস নাক থেকে যত দূরেই হোক না কেন (ফ্রন্টাল, স্ফেনয়েড)  তার ভেতরে সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করে পলিপটাকে সম্পূর্ণভাবে বের করে ফেলা সম্ভব। সবগুলো সাইনাস থেকে পলিপ অপসারণের সার্জারিকে FULL HOUSE FESS ও বলে।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এন্ডোস্কোপের সাহায্যে পলিপ ফেলে দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো অপারেশন নেই। পলিপগুলো তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে সম্পূর্ণভাবে ফেলে দিলে সাধারণত নতুন করে পলিপ হয় না।

 

ডা. আব্দুল্লাহ মারযূক

এমবিবিএস (ডিএমসি), এমএস ফেইজ বি নাক কান গলা বিভাগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাস্পাতাল।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.