অস্টিওআর্থ্রাইটিস মূলত কী?

কোন বয়সীদের এ রোগে বেশি দেখা দেয়?

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত এ রোগ বেশি দেখা যায়। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পুরুষ ও নারী উভয়েরই এ রোগ হতে পারে। কিছু গবেষণা থেকে দেখা গেছে, ৪০-৪৫ শতাংশ মানুষের এ রোগ দেখা দিতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগটা বাড়তে থাকে।

এ রোগের মূল কারণগুলো কী কী?

আমরা এ রোগের ক্ষেত্রে যেগুলোকে রিস্ক ফ্যাক্টর বলে থাকি সেগুলো হলো জেনেটিক বা বংশানুক্রমিক। দেখা যায় কারো মায়ের ছিল বা বাবার ছিল তারও হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ রোগ মূলত বংশানুক্রমিক। অস্টিওআর্থ্রাইটিস মূলত কিছু কিছু জয়েন্টে বেশি হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয় হাঁটুতে। হাঁটুর পাশাপাশি এটা হিপ জয়েন্টে হতে পারে। এছাড়া মেরুদণ্ডের হাড়ে, কোমরের এবং ঘাড়ের হাড়েও হতে পারে। পুরুষ ও নারী উভয়েরই হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি এটা হয় হাঁটুতে। এটা মূলত বংশগত সমস্যা। তবে কিছু ক্ষেত্রে পরিবেশেরও প্রভাব রয়েছে। পরিবেশগত মানে হলো তার চলাফেরা কেমন, কতটুকু হাঁটুর ওপর চাপ পড়ে বা কত বছর ধরে সে হাঁটুর ওপর চাপ পড়ে এমন কাজ করছে, তার উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কেমন, এসব বিষয়ের ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। তার যদি হাঁটুতে কোনো আঘাত থাকে সেটাও তার জন্য দায়ী। যদি সে দীর্ঘদিন ধরে ফুটবল খেলে থাকে, এছাড়া কৃষক মানুষ তাদের বারবার হাঁটুর ওপর চাপ পড়ে, যারা মাইনে (খনি) কাজ করে, এটা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, হাঁটুতে কোনো অপারেশন হয়েছিল এভাবেও কিছু ফ্যাক্টর থাকে। তবে এটা বংশগত সমস্যা, হাঁটুতে ঝামেলা থাকে, শরীরের ওজন বেশি থাকে, সে কারণেই হয়ে থাকে। ৫০ বছরের আগে-পরে মানুষের শরীরের হরমোনাল অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। নারীদের ক্ষেত্রে এ সময়ে হরমোনাল কিছু ঝামেলা তৈরি হয়। তখন তাদের এ রোগটা দেখা দেয়।

এ রোগের লক্ষণগুলো কী কী?

এ রোগের মূল লক্ষণ হলো হাঁটুতে ব্যথা, মূলত জয়েন্টে ব্যথা। হাঁটুর ব্যথা নিয়েই রোগীরা আমাদের কাছে বেশি আছে। এটা মূলত আমরা বলে থাকি বয়সজনিত সমস্যা, অর্থাৎ প্রাকৃতিক সমস্যা। রোগীদের মধ্যে অনেক সমস্যা দেখা যায়। কেউ একজন এসে বলে ইদানীং তার হাঁটু গেড়ে বসতে সমস্যা হয়, নামাজ পড়তে সমস্যা হয়। নিচে বসে তরকারি কাটা, কাপড় কাচা, বঁটিতে বসে কাজ করা অর্থাৎ মায়েরা যে নিয়মিত বসে কাজ করে ইত্যাদি করতে সমস্যা হয়। নিচে বসে কৃষকরা যে কৃষিকাজগুলো করেন সেখানে বারবার তাদের নিচে বসা লাগে, এ কাজগুলো করতে সমস্যা হয়। আগে এ কাজগুলো করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, ইদানীং এ কাজগুলো করতে সমস্যা হয়। এছাড়া সিঁড়িতে ওঠানামা করতে সমস্যা হয়। মূলত রোগীরা এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসে। এছাড়া অন্যান্য সামান্য কিছু উপসর্গ নিয়ে আসে, যেমন এ রোগের ক্ষেত্রে কোমর ব্যথা বা ঘাড়ে ব্যথাও হতে পারে। আমরা হাঁটু ব্যথার ক্ষেত্রে সাধারণত কী কী কাজ করতে গেলে সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলো দেখি। এছাড়া রোগীর যেই ব্যাকগ্রাউন্ড আছে তাও অনেক ক্ষেত্রে চেক করি। যেমন ব্যথা কখন হয়, রাতে নাকি দিনে, কতক্ষণ থাকে। তবে রাতে সাধারণত মানুষের ব্যথা থাকে না, সকালে ওঠার পর সমস্যা দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সকালে ওঠার পর পা নড়াচড়া করা যায় না। অনেকেই বলে আমি ঘুম থেকে ওঠার পর হাঁটতে পারি না। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আর ব্যথা থাকে না, স্বাভাবিক হয়ে যায়।

এ রোগে চিকিৎসাপদ্ধতি কী?

যখন কেউ এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে তখন আমরা প্রথমে রোগীর ইভ্যালুয়েশন করি, রোগটা দেখি এবং বিবেচনা করি। বয়স কত, জীবনাচরণ কেমন, শরীরের কী অবস্থা, আগে থেকে কোনো রোগ আছে কিনা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে আসি। এসবের ওপর ভিত্তি করে আমরা আসলে ফোকাস করি রোগীর কী হয়েছে। কেন রোগী কষ্ট পাচ্ছে। এরপর আমরা সরেজমিনে পরীক্ষা করি—রক্তশূন্যতা আছে কিনা, তার পালস কেমন। পাশাপাশি আমরা তার হাঁটু পরীক্ষা করি, ঘাড়ে সমস্যা থাকলে ঘাড় পরীক্ষা করি। রোগীর অনুমতি নিয়েই আমরা এসব পরীক্ষা করি। এরপর আমরা দেখি তার আর কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা লাগবে কিনা। আমাদের যদি বিবেচনায় আসে পরীক্ষা নিরীক্ষা না করলেও চলবে তখন ওষুধ দিই। পাশাপাশি রোগীকে হাঁটুর কিছু ব্যায়াম করতে বলি। যদি রোগীর হঠাৎ করে বেশি খারাপ লাগে তাহলে আমরা কিছু পরীক্ষা করতে বলি। রোগীকে মূলত আমরা একটা এক্স-রে করতে দিই। হাঁটুর ব্যথা হলে হাঁটুর এক্স-রে করতে দিই। এছাড়া আনুষঙ্গিক আরো পরীক্ষা করতে হয়—কিডনি ফাংশন ঠিক আছে কিনা। রোগীর হিস্ট্রি নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় ইভ্যালুয়েশন রাখি আমরা। এসব পরীক্ষা করার মাধ্যম আমরা বিবেচনা করি কী ধরনের চিকিৎসা করা যায়। আমরা যদি দেখি তার আগে কোনো সমস্যা ছিল না, তখন আমরা তাকে বুঝিয়ে বলি, টেনশন যাতে না করে, এটা একটা স্বাভাবিক সমস্যা। এটা জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত, এটা বংশানুক্রমেও হয়ে থাকে। রোগী ভালো আছে বলে আশ্বাস দিই। রোগীকে কাউন্সেলিং করি। যে কারণে হাঁটু ব্যথা বেড়েছে সে কারণগুলো যদি আমরা তাকে জানিয়ে দিতে পারি সে সাবধানতা অবলম্বন করলে রোগী ভালো থাকতে পারবে। তবে এ রোগ নিয়ে ভালো থাকা সম্ভব। রোগীর অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে এক্ষেত্রে আমরা রোগীকে ব্যথানাশক ওষুধই দিই। সেটা অবশ্যই ডাক্তারের বিবেচনা সাপেক্ষে ও পরামর্শ অনুযায়ী। এ ধরনের চিকিৎসা অবশ্যই একজন ভালো ফিজিশিয়ান দিয়ে করানো উচিত। এর বাইরে কোনো চিকিৎসকের কাছ থেকে যদি রোগী চিকিৎসা করায়, তাহলে তার উপকারও হতে পারে আবার ক্ষতিও হতে পারে। শুধু ব্যথানাশক ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা না। বাংলাদেশের সব হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা হয়। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোয় অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্ট আছে, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আছে। ওষুধের পাশাপাশি কী ধরনের ব্যায়াম লাগবে তা বলা হয়ে থাকে। হাঁটু ব্যথার কারণে যেগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর সেগুলো থেকে বিরত থাকা। ওজন কমানো, নিচে না বসা, সিঁড়ি দিয়ে বেশি ওঠানামা না করা, লিফট ব্যবহার করা, হাই কমোড ব্যবহার করা ইত্যাদির মাধ্যমে রোগী সুস্থ থাকতে পারে।

এ রোগ প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন?

যদি রোগীর পরিবারের ক্ষেত্রে জেনেটিক সমস্যা থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে তো কিছু করার থাকে না। তবে যে এনভায়রনমেন্টাল কারণগুলো আছে যা তার হাঁটু ব্যথা বাড়াচ্ছে অর্থাৎ রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কমাতে হবে। অর্থাৎ হাঁটুর ওপর থেকে লোড কমাতে হবে। যেমন নিচে না বসা, সিঁড়িতে ওঠানামা কম করা, বঁটিতে বসে কাজ না করা, যাদের সমস্যা আছে তাদের কৃষিকাজ থেকে বিরত থাকা। রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো মডিফাই করার মাধ্যমে রোগগুলো থেকে অনেকটা সুস্থ থাকা যায়।

খাদ্যাভাসের সঙ্গে এ রোগের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।

খাবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলবে। তবে এ রোগের সঙ্গে ওজনের একটা সম্পর্ক আছে। হাই প্রোটিন বেশি আছে যেগুলো সে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা ভালো। এছাড়া শিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি এসব এড়িয়ে যাওয়া। রাতের ডিনারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সাবধানতা অবলম্বন করা। রাতে ঘুমানোর ২ ঘণ্টা আগে ডিনার করা উচিত। এছাড়া খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে এ রোগের কোনো সম্পর্ক নেই।

 

ডাঃ মােঃ আরিফুল ইসলাম

এমবিবিএস, এফসিপিএস বাত ব্যাথা, প্যারালাইসিস ও আথ্রাইটিস বিশেষজ্ঞ,শারীরিক মেডিসিন

সহযোগী অধ্যাপক ফিজিক্যা মেডিসিন,

রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

 

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.