গতকাল এক রোগী আসলেন, কিছুদিন আগে যিনি হার্টে রিং লাগাইছিলেন। এখন টুকিটাকি কিছু সমস্যা হচ্ছে তাই ফলোআপে এসেছিলেন। আমি রোগীকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি হয়েছিলো। কেন রিং লাগিয়েছেন আর রিং কে লাগাতে বলছে?

রোগী বলেন, ‘বুকে ব্যথা উঠছিল, তাই একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাই।

উনি বলে হাসপাতালে ভর্তি হোন কিছু ওষুধ দিব, ৪-৫ দিন ভর্তি থাকা লাগবে। তারপর বাড়ি চলে যাবেন।

এটা শুনে আমি চিন্তা করছি, ৪-৫ দিন প্রাইভেট হাসপাতালে সিসিইউতে ভর্তি থাকতে যে টাকা লাগবে তা দিয়ে তো রিংই লাগানো যায়। আমি অন্য জায়গায় গিয়ে রিং লাগাই ফেলছি।’

এই শুনে আমি কি স্বপ্নে দেখছি কিনা বুঝতেছিলাম না। ইচ্ছা করতেছিলো দাঁড়িয়ে রোগীকে বুট কড়মড় একটা স্যালুট মারি। ব্যাটা কয় কি!

আমি বললাম, তো হার্ট এটাক হলে যে রিং লাগাতে হয় আপনি কেমনে জানেন?

এবার তিনি বোমাটা ছাড়লেন, যেন তেন না। একেবারে পারমাণবিক বোমা।

উনি বললেন, স্যার, পুরান রোগী আর নতুন ডাক্তার সমান! (আমি মনে মনে বলি… আহেম…আহেম…)

রোগী বলতে লাগলো, ওনার দীর্ঘদিন হার্টের সমস্যা। বাংলাদেশ ভারত সব দেখা শেষ। হার্টের চিকিৎসা নিয়ে উনি বেশ পড়াশুনাও করছেন। আসলে স্মার্টনেসের জন্য পড়াশুনার বিকল্প নেই।

তো আসুন জেনে নিই….

রিং জিনিসটা আসলে কি

হার্টের রিং কে বলতে হবে গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিস্কারগুলোর একটা। এটা বিভিন্ন ধাতুর তৈরী খুবই সূক্ষ তারজালির মত, গ্রামে ছোট গাছগুলোকে রক্ষার জন্য বাঁশের তৈরি যে ঘেরাও দেয়া হয় অনেকটা তেমন আকৃতির জিনিস।

হার্টে যেখানে ব্লক হয়। সেই ব্লক বরাবর এই জিনিসটা বসিয়ে এটার ভিতরে একটা বেলুন দিয়ে বেলুনটাকে ফুলানো হয়। ফলে রিংটা বড় হয়ে ব্লকটাকে খুলে দেয়। আর রক্ত চলাচল শুরু হয়।

রিং কোনটা ভালো?

দুই ধরণের রিং পাওয়া যায়।

১. একটাতে শুধু ধাতব পদার্থ থাকে। যেটাকে বলে বিএমএস (BMS).

২. আরেকটাতে ধাতুর উপরে মেডিসিন দেয়া থাকে,যেটাকে বলে ডিইএস(DES).

BMS এর চেয়ে DES ভালো। সাধারণত আমরা DES ব্যবহার করি।

রিং লাগালে কি ওষুধ খেতে হয়?

আসলে হার্ট এটাক বা হার্টে রক্তপ্রবাহে সমস্যা আছে এমন সব রোগীকেই সারাজীবন কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। রিং লাগালেও এগুলো খেতে হবে। তবে একটা সময় পরে ওষুধ কিছুটা কমানো যায়।

রিং কখন লাগালে ভালো?

আসলে রিং লাগানোর উত্তম সময় হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে লাগানো। যত তাড়াতাড়ি রিং লাগানো যায় তত কার্যকর। রিং লাগানোর আরেক নাম স্ট্যান্টিং। পদ্ধতিটাকে বলে পিসিআই (PCI) ।

যদি হার্ট অ্যাটাকের সাথে সাথে ব্লক খোলার কোন ঔষধ না দিয়েই রিং লাগানো হয় তবে এটাকে আমরা বলি প্রাইমারী পিসিআই।

এখন পর্যন্ত হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসা পিসিআই।

যদি সাথে সাথে প্রাইমারী পিসিআই করা না যায় তাহলে কিছু ওষুধ আছে, এগুলো দিয়ে ব্লক খোলার চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় এনজিওগ্রাম করে ব্লক থাকলে রিং পরানো যায়, যেটাকে বলে ফার্মাকো-ইনভেসিভ পিসিআই।

এই দুই উপায়েই রোগীর লাভ বেশি। কিন্তু আমাদের রোগীরা সময়মত আসে না। আসলেও গড়িমসি করে।

তারা প্রথমে ঔষধ দিতে বলে। কিছুটা সুস্থ্য হয়ে বাড়ি যায়।  পরে যখন আবার এটাক বা ব্যথা হয় তখন রিং লাগাতে আসে। ততদিনে খুব বেশি আসলে লাভ হয় না।

রিং না লাগিয়ে কি শুধু ওষুধ দিয়ে হার্ট এটাকের চিকিৎসা হয়?

রিং না লাগিয়ে শুধু ঔষধ দিয়ে হার্ট এটাকের চিকিৎসা হয়। তবে আমাদের দেশে যে ইনজেকশনগুলো ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সঠিক সময়ে দিলেও শুধু ইনজেকশন দিয়ে হার্ট এটাকে ব্লক খোলার সম্ভাবনা ৬০-৭০ শতাংশ। দেরি হলে এর সম্ভাবনা আরো কমে যায়।

এগুলো আসলে হার্ট অ্যাটাকের জলীয় চিকিৎসা, আধুনিক বিশ্বে এসব “বনসাই” চিকিৎসা দিন দিন কমে আসতেছে।

হার্ট এটাক হলে কী করতে হবে?

১. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

২. ভর্তি হয়ে এনজিওগ্রাম করতে হবে, ব্লক থাকলে রিং পরাতে হবে।

৩. সম্ভব না হলে কমপক্ষে ইনজেকশন বা জলীয় চিকিৎসা নিতে হবে।

কোথায় রিং পরানো যায়?

ঢাকার বাইরে সরকারী মেডিকেল কলেজের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ক্যাথল্যাব (এক ধরনের অপারেশন থিয়েটার,যেখানে হার্টের বিভিন্ন ইন্টারভেনশন হয়) আছে। এসব জায়গায় রিং পরানো হয়। এছাড়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা এবং দিনাজপুরে বেসরকারী হাসপাতালেও করা যায়।

কত পার্সেন্ট ব্লক থাকলে রিং লাগাতে হয়?

হার্টের মূল রক্ত নালী দুইটা।

১. একটা টা বাম পাশের প্রধান রক্তনালী যেটার দুইটা শাখা।

২. অন্যটি ডানপাশের রক্তনালী।

এই তিনটা রক্তনালীর যে কোনটা বা এগুলোর মোটা কোন শাখা তে সাধারণত ৭০ শতাংশ বা তার বেশি ব্লক হলে রিং লাগাতে হয়। এর নীচে হলে রিং না লাগিয়ে ওষুধ খেলেও চলবে।

তবে বামপাশের মূল রক্তনালীতে ৫০ শতাংশ ব্লক হলেও রিং লাগবে।

তাহলে বামপাশের মূল রক্তনালীতে ৫০ শতাংশ, এর শাখাতে ৭০ শতাংশ, ডানপাশেরটা বা তার মোটা কোন শাখাতে ৭০শতাংশ হলে রিং লাগাতে হবে। তবে বিশেষ কিছুক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে।

যদি তিনটা রক্তনালীতেই ব্লক থাকে, যেগুলোতে রিং লাগানো যাচ্ছে না অথবা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে দুই বা তিনটা বড় ধরণের ব্লক থাকে সেক্ষেত্রে বাইপাস অপারেশন ভালো।

খরচ কেমন?

রিং পরানোর আগে এনজিওগ্রাম (রক্তনালীর পরীক্ষা) করে দেখতে হয় ব্লক আছে কিনা এবং রিং লাগবে কিনা।

শুধু এনজিওগ্রামে সরকারি হাসপাতালে ঔষধসহ সব মিলিয়ে খরচ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। প্রাইভেটে বিশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা।

রিং লাগলে মোটামুটি ভালোমানের রিংয়ের ক্ষেত্রে ১ টা রিং সরকারি হাসপাতালে সত্তর হাজার থেকে এক লক্ষ টাক লাগে।

বেসরকারি হাসপাতালে ক্ষেত্রভেদে এক লাখ আশি হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। এছাড়া কর্পোরেট হাসপাতালে আরও বেশি লাগতে পারে।

চট্রগ্রামে প্রাইভেট হাসাপাতালেও এক লাখ আশি হাজার থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে হয়ে যায়। রিং লাগানোর পরও দুই থেকে তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। যা ওই প্যাকেজের মধ্যে ধরা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এনজিওগ্রাম বা রিং পরানো হয়?

চট্টগ্রাম মেডিকেলে যতগুলো ওয়ার্ড আছে তারমধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ওয়ার্ড কার্ডিওলজি। এখানে এনজিওগ্রাম, রিং পরানো, পেসমেকার লাগানোসহ হার্টের আরো অনেক আধুনিক ডিভাইস লাগানো হয়।

দেশবরেণ্য কয়েকজন অভিজ্ঞ কার্ডিওলজিষ্ট এখানে নিয়মিত এসব প্রসিডিওর করেন। খরচ ও অনেক কম।

কতটা ঝুঁকি?

পৃথিবীর সব চিকিৎসায় ঝুঁকি আছে। হার্ট এটাকের রোগীর রিং না পরালে যে ঝুঁকি, রিং পরানো তার চেয়ে অনেক অনেক কম ঝঁকির।

তাহলে হার্ট এটাক হলে রিংই ভালো?

শেষকথা হচ্ছে হার্ট এটাকের পর যারা সঠিক সময়ে রিং পরানোর মত সুযোগ পান বা পরাতে পারেন তাদের মত সৌভাগ্যবান আর হয় না।

 

ডা. ইকবাল মাহমুদ, এমডি (কার্ডিওলজি),

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.