রক্ত দুটি উপাদান নিয়ে গঠিত। এর একটি রক্তকণিকা (কোষ), অন্যটি রক্তরস। রক্তশূন্যতা হলো রক্তের এমন একটি রোগ, যেখানে রক্তের লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিন নামের উপাদানটি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম থাকে। একে অ্যানিমিয়াও বলে।

হিমোগ্লোবিন দুটি উপাদান নিয়ে তৈরি হয় হিম ও গ্লোবিন। হিম আসে আয়রন থেকে আর গ্লোবিন হলো আমিষ বা প্রোটিন। হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। ফলে শরীরের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি উপাদান।

রক্তশূন্যতা নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে এখনো জানার কিছুটা কমতি, কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও অসচেতনতা রয়ে গেছে; বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে, যেখানে জ্ঞান এবং স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব অনেকাংশে বেশি।

রক্তস্বল্পতার লক্ষণ

আমরা অনেকে রক্তস্বল্পতার সব লক্ষণ জানি না বা জানলেও লক্ষণগুলো এমন যে সেগুলো অন্য কোনো রোগের লক্ষণ মনে করে ভুল করে থাকি বা একে আদৌ কোনো রোগ মনে করি না। যেমন গ্রামীণ নারীদের মধ্যে একধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়; তাঁরা মনে করেন, হাসপাতালে এসে ইনজেকশনের মাধ্যমে স্যালাইন দিলেই শরীরের সব ধরনের দুর্বলতা কেটে যাবে। আবার দুর্বলতা, অবসন্নতা বা এ ধরনের কোনো উপসর্গের জন্য তাঁরা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতেও আগ্রহী নন। অথচ রক্তস্বল্পতা শারীরিক দুর্বলতার অনেক বড় একটি কারণ। এভাবে রক্তস্বল্পতার অনেক লক্ষণ উপেক্ষিত হয় বলে রোগনির্ণয় ও নিরাময় সম্ভব হয় না।

তাই রক্তস্বল্পতার লক্ষণগুলো জেনে রাখা জরুরি।

» দুর্বলতা, ক্লান্তি, অবসাদ
» শারীরিক পরিশ্রমের ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং অল্পতে হাঁপিয়ে ওঠা
» কাজে মনোযোগী হতে না পারা
» চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
» মাথা ঘোরা ও মাথাব্যথা
» চোখে ঝাপসা দেখা
» রক্তশূন্যতার মাত্রা তীব্র হলে শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এমনকি রক্তশূন্যতা থেকে হার্ট ফেইলিউর পর্যন্ত হয়।

রক্তশূন্যতার কারণ

রক্তস্বল্পতার কারণকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। রক্তে উপাদান তৈরি না হওয়া এবং ক্ষরণ বা ভেঙে যাওয়া।
গ্রামীণ নারীদের রক্তস্বল্পতার প্রধান কারণ অপুষ্টি। খাদ্যে পর্যাপ্ত আয়রন ও প্রোটিন না থাকলে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না। এ ছাড়া কিছু ভিটামিন, যেমন বি১২, ফলিক অ্যাসিড হিমোগ্লোবিন তৈরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।

যেসব কারণে নারীদের রক্তক্ষরণ হয়, সেগুলোর মধ্যে আছে ঋতুস্রাব, সন্তান প্রসব, অনিরাপদ গর্ভপাত। এ ছাড়া পেপটিক আলসার, কৃমির সংক্রমণ, পাইলস, পাকস্থলী বা পরিপাকতন্ত্রের কোথাও ক্যানসার, দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে দৃষ্টির অগোচরে শরীর থেকে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ হয়। এ ছাড়া কিডনি ফেইলিউরেও রক্তস্বল্পতা হয়।

করণীয়

প্রথমে জরুরি রক্তস্বল্পতা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি। রোগটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে লক্ষণ সন্দেহে পরীক্ষা করে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু শনাক্ত করলেই হবে না, এর পেছনের কারণ নির্ণয় করা না গেলে সঠিক চিকিৎসা ও নিরাময় সম্ভব নয়। ফলে রক্তস্বল্পতার লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। চিকিৎসক এর মাত্রা ও কারণ বুঝে চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতায় আয়রন ট্যাবলেট, আয়রন ইনজেকশন, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে রক্তসঞ্চালন এবং অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে সেই রোগের চিকিৎসা দেবেন।

রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে করণীয়

» পুষ্টি নিশ্চিত করা
» পুষ্টিকর খাবার মানেই দামি খাবার—এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে হবে।

গ্রামে প্রচুর পরিমাণে যে টাটকা সবুজ শাকসবজি পাওয়া যায়, তা আয়রনের অন্যতম উৎস। ডিম একটি সুষম খাবার, যাতে থাকে আয়রন, প্রোটিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন। এ ছাড়া মাছ ও মাংসে আয়রন এবং প্রোটিন—দুটি উপাদানই থাকে। প্রোটিনের আরেকটি ভালো উৎস ডাল। কয়েক রকম ডাল একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করলে সেটি অধিকতর পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

গর্ভবতীদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতেই হবে। এটিও পুরুষের তুলনায় নারীদের রক্তস্বল্পতা বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ। মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত না হলে সুস্থ সন্তান পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ-সংক্রান্ত জটিলতা সামাল দেওয়া যেমন মুশকিল হয়ে যাবে, প্রসব-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ মেয়াদে এটি মাকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দেবে।

ফলে একজন গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত চেকআপ, তাঁর বিশ্রাম ও পুষ্টি নিশ্চিত করে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে হবে।

রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে

» অতিরিক্ত ঋতুস্রাব বা শরীরের অন্য কোনো ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
» অনিরাপদ গর্ভপাত রোধ করতে হবে।
» হাসপাতাল বা অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে দক্ষ ও নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে হবে।
» প্রসব-পূর্ববর্তী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রক্তের গ্রুপ জেনে রক্তদাতা জোগাড় করে রাখতে হবে।
» চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।
» নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করতে হবে।
» কৃমির সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

 

ডা. শাফেয়ী আলম তুলতুল

মেডিকেল অফিসার কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গাজীপুর।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.