পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর জন্য অসংক্রামক যত কারন আছে তার মধ্যে সবচেয়ে আগে বলতে হয় হৃদরোগের নাম।  বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুর হার দিনদিন বেড়েই চলেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে প্রতি দেড় সেকেন্ডে পৃথিবীতে একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, আর বাংলাদেশে প্রতি ৩ মিনিটে ১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যায়।

হার্টের রোগের জন্য, বিশেষ করে প্রেশার ও হার্ট এটাকের কারণ হিসাবে  সিগারেট-জর্দাসহ অন্যান্য তামাকজাতীয় খাবারের কথা আজ অনেকেই জানে। অধিক চর্বিজাতীয় খাবারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু একটি নীরব হন্তারক যা মানুষের হৃদযন্ত্রকে ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে তা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি। গবেষণায় দেখা গেছে হার্টের রোগের জন্য সিগারেটের মতো, বা তারচে বেশি দায়ী হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। দুশ্চিন্তা, উত্তেজনা,  বিষন্নতাসহ যে কোন মানসিক সমস্যা থেকে উচ্চ রক্তচাপ,  বুকে ব্যথা,  বুক ধড়ফড় থেকে শুরু করে ছোট বড় হার্টের রোগ, এমনকি হার্ট এটাক করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে পারে।

একজন মানুষের চিন্তাভাবনা ও আবেগ অনুভূতি তার হার্টের স্বাস্থ্যের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। দুশ্চিন্তা, অতিরিক্ত টেনশন ও রাগ বা ক্রোধ হার্টের ক্ষতি করতে পারে। হঠাৎ রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে একজন মানুষের রক্তচাপে অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। এই চাপ থেকে মস্তিষ্কে রক্তনালি ছিঁড়ে স্ট্রোক করতে পারে।  পাশাপাশি  হার্টে চাপ পড়তে পারে,  যা থেকে হার্ট এটাকও করতে পারে। হঠাৎ কোন দু:সংবাদ  শুনে মানসিক শক পেয়ে এরকম মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই শোনা  যায়।

তাছাড়া দীর্ঘদিন হতাশায় ভুগে, বিশেষত আর্থিক, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা পেশাগত জীবনের বিষন্নতা থেকে হার্টের কঠিন রোগ হতে পারে- যেমন টাকুটসোভো কার্ডিও মাইওপ্যাথি ( Tsakutsuvo Cardiomyopathy)। অত্যধিক মানসিক চাপ বা বিষন্নতা থেকে শরীরে স্ট্রেস হরমোন এর অতিরিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী নি:সরন এই রোগের কারন বলে ধারণা করা হয়।

দীর্ঘদিন বিষন্নতায় ভুগলে যেমন সুস্থ লোকের হার্টের অসুখ দেখা দিতে পারে,  তেমনি আগে থেকে হার্টের অসুখ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের অর্ধেকই পরবর্তীতে  বিষন্নতায় ভোগে। আর বিষন্নতায় ভোগা রোগীদের হার্ট এটাক করার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এভাবে রোগীর জীবন হৃদরোগ ও বিষন্নতার একটি চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। হৃদরোগের পরে মানসিক দুশ্চিন্তা, আতংক আর দুর্বলতা পুনরায় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

তাছাড়া হার্ট এটাক করলে তা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হলে মানসিক শান্তি ও সুস্থতার বিকল্প নেই। বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তা থাকলে এই প্রক্রিয়া এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যে রোগী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। সুখী ও প্রশান্ত  মানুষের শরীরে কর্টিসল সহ অন্যান্য হরমোনের মাত্রা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকে যে তার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম থাকে,  বা হলেও তাড়াতাড়ি সেরে যায়।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে ও হার্ট এটাকের পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হলে সবাইকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যেমন:

প্রথমেই দরকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।  পরিচিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ যিনি আপনাকে মানসিক ব্যাপারে সাপোর্ট দিতে পারেন তার সাথে যোগাযোগ করুন।

মনে রাখা দরকার একজন মানুষ একা তার সব সমস্যা সমাধান করতে পারে না। সকল সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা বাদ দিতে হবে। কিছু না পাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে হবে।  একটি অভ্যাস (যেমন, খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা) পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করা ভালো।  একটি যুক্তিসঙ্গত প্রাথমিক লক্ষ্য সেট করে সেটা পূরণের জন্য কাজ করা উত্তম।

বিষণ্নতা যাতে নিজেকে আচ্ছন্ন করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিষণ্ণতা, হতাশা বা দু:খের অনুভূতি আর খাওয়া ও ঘুমের ব্যাঘাত  যদি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে হার্টের ডাক্তারের সাথে এই সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করা উচিত। প্রয়োজনে একজন মনোবিজ্ঞানীর সাথেও পরামর্শ করা যেতে পারে।

জীবনের স্ট্রেসের কারণ চিহ্নিত করে সেগুলি কমানোর উপায় বের করতে হবে। মানসিক চাপের সাথে মানিয়ে নেওয়া শিখতে হবে। নিয়মিত এরোবিক শরীরচর্চা হৃদরোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি মনে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, যা হার্ট অ্যাটাক থেকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্যও উপকারী।

পরিবারের সবাইকে, বিশেষ করে স্বামী বা স্ত্রীর সাথে সমস্যা শেয়ার করতে হবে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব  এবং সহকর্মীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রাখতে পারে।  হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী সময়ে হতাশা এবং একাকীত্বের অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে সামাজিক সমর্থন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

হার্ট আপনার।  মনও আপনার। রাগ, হতাশা, দু:খ, বিষন্নতা,  দুশ্চিন্তা এগুলি সবই আপনার মনের স্বাস্থ্য বিনষ্ট করে, আর প্রকারান্তরে আপনার হার্টকে কুড়ে কুড়ে খায়। তাই মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখুন, নিজের হৃদয়মনকে ভালোবাসুন, আপনার হার্ট ভালো থাকবে।

 

লেখক:

ডা. এস এম ইয়ার ই মাহাবুব

সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজি, বিএসএমএমইউ

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.