কিডনির একটি বড় কাজ হল রক্তকে ছেঁকে দুষিত পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করা। আর শরীরের প্রয়োজনীয় জিনিষ আবার শরীরকে ফিরিয়ে দেয়া। কিডনি রোগ নেফ্রোটিক সিনড্রমে রক্তে থাকা প্রোটিনের বড় একটি অংশ প্র¯্রাবের সাথে বের হয়ে যায়। ফলে রক্তের পানীয় অংশ রক্তনালী থেকে বের হয়ে টিসুতে চলে আসে। ফলাফল শরীর ফুলে যায়। এসব রুগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। এটা ছোট বড় সবারই হয় তবে বাচ্চাদের ১ থেকে ৬ বছরের মধ্যেই এই রোগের প্রবণতা বেশী। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদেরই এটা বেশী হয়। এই সময়ে রুগীদের বমি বা বমি ভাব, পেটে ব্যথা ও শরীর অত্যধিক ফুলে যাওয়ার মত লক্ষণ থাকে।

নেফ্রটিক সিনড্রমের প্রধান লক্ষণগুলি কি?

১। পা, হাত, মুখ পেট, শরীর ফুলে যাওয়া
২। প্র¯্রাবে প্রচুর পরিমান এলবুমিন (প্রটিন) বের হয়ে যাওয়া।
৩। রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া।
৪। প্রস্রাবের পরিমাণ অত্যধিক কমে যাওয়া।

কেন হয় নেফ্রোটিক সিন্ড্রম:
বড়দের ডায়াবেটিস থেকে এটি হতে পারে, ডায়াবেটিসের কারনে গ্লোমেরুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এমনটা হয়।
বাচ্চাদের প্রধান ধরন কিন্তু মিনিমাল চেন্জ নেফ্রটিক সিন্ড্রম যা স্টেরয়েড চিকিৎসায় ভাল হয়ে যায়। তবে এটি বারবার হতে পারে। খারাপ পর্যায়ে রোগটি ভাল না হয়ে কিডনি বিকলের দিকেও চলে যেতে পারে।
ফোকাল সেগমেন্টাল স্কে¬রোসিস বড়দের বেশী হয়, এর ফলাফল বেশী ভাল নয়।

মেব্রেনো প্রলিফারেটিভও খারাপ একটি ধরন।
এসএলই দিয়েও এটা হতে পারে।
এমাইলয়ডোসিস থেকেও এটি হয়।

এই রোগে চোখের চারদিক, হাত, পা, শরীর ফোলে কেন?

কিডনি শরীরের প্রয়োজনীয় প্রটিন (এলবুমিন ) ধরে রাখতে পারে না। কিডনির ছাকনি তার কার্যকারীতা হারিয়ে ফেলায় এই বড় সাইজের প্রটিনও তখন শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ফলে রক্তে এলবুমিনের স্বল্পতা দেখা দেয়, যার কাজ ছিল প্লাজমা অঙ্কোটিক প্রেসার ঠিক রাখা। তখন কলার ফাকে রক্তের পানীয় অংশ জমতে থাকে। তাই চোখের চারপাশ, হাত, পা, শরীর ফোলা দেখা যায়।

এই অসুখে কি কি জটিলতা হতে পারে:
বা”্চাদের নেফ্রটিক সিন্ড্রমের ৮০% এর উপরই হয় মিনিমাল চেন্জ যা সহজেই জটিলতা ছাড়াই ভাল হয়। তবে বাচ্চার অপুষ্টি একটি সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়।
বড়দের এবং কোনও কোনও বাচ্চার যখন অন্য কোন ধরনেরটা হয়ে কিডনিতে স্কার হয়ে যায় তখন অনেক দিন ধরে প্রটিন ক্ষয় হতে থাকে আর জটিলতা বাড়তে থাকে।

আর এই জটিলতা রোগের কারনেও হতে পারে আবার চিকিৎসার ওষুধের কারনেও হতে পারে।
রোগের কারনে যা সচরাচর হয় তা হল: সংক্রমন-পেটে সংক্রমন (পেরিটোনাইটিস), সেপসিস, চিকেন পক্স, সেলুলাইটিস। থ্রম্বএম্বলিজম-শিরায় ও ফুসফুসে। পানি কমে যাওয়ার কারনে পেটে প্রচন্ড ব্যথা, প্রেসার কমে যাওয়া, শ্বাস কষ্ট। কোলেস্টেরল বেড়ে গিয়ে হৃদরোগ হতে পারে। এছাড়াও রক্ত শূন্যতা, কিডনি বিকল, ক্যালসিয়াম কমে যাওয়া, নাড়ে প্যাচ লাগার মত ঘটনাও হতে দেখা যায়।

অনেক দিন স্টেরয়েড ব্যাবহারের ফলে কিছু শারীরিক সমস্যা হয়-যেমন মুটিয়ে যাওয়া, প্রেসার বেড়ে যাওয়া, চোখে ছানি পড়া, কুসিংয়ের মত সব সমস্যা, এটাকে বলে আয়াট্রোজেনিক কুসিং। আবার এলকালিনাইজিং ওষুধ, সাইক্লোস্পোরিন, সাইকেøাফসফামাইডের কারনেও অনেক সমস্যা হতে পারে।

এই রোগ হলে কি কি না খাওয়া ভাল:
প্রসেস্ড খাবার ও লবন যুক্ত খাবার এসময়ে না খাওয়াই ভাল।
চিপস, পপকর্ণ, লবন যুক্ত বাদাম, সসেজ, হট ডগ, পেপারোনি খাবেন না।
চিজ, শুকনা পাস্তা, আচার, নোনতা বিস্কুট বা ব্রেড খাবেন না।
কোন ধরনের লবণ যুক্ত স্যুপ খাওয়া নিষেধ।

নেফ্রটিক সিন্ড্রম রুগীর খাবার দাবার: যদিও আমাদের দেশে বিশেষ করে বাচ্চাদের জন্য খাবার বাছাই করা খুব ঝামেলা জনক তারপরও চিকিৎসার জন্য এটা করতেই হয়।
প্রটিন প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১ গ্রাম বরাদ্দ, এর বেশী নয়। তবে ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে কিছুটা শিথিলতা নেয়া যায়, যা বাচ্চার স্বাস্থের সাথে সম্পর্কিত।

খাবারে থাকা লবন প্রতি বেলায় কোন ভাবেই ৪০০ মি:গ্রামের বেশী হবে না।
লবনের বদলে তাজা রসুন বা রসুনের গুড়া দিয়ে খাবারের স্বাদ বাড়াতে পারেন।
খাবার বাসায় তৈরী করুন, কারন হোটেলের খাবারে স্বাদ বাড়ানোর জন্য বাড়তি লবন থাকে।
স্বাস্থকর জলপাই তেল বা নারিকেল তেলের খাবার খেতে পারেন।
খাবার টেবিলে অবশ্যই কোন ধরনের লবন থাকবে না।
লবন ছাড়া তরিতরকারি সিদ্ধ করে খেতে পারেন।

নেফ্রটিক সিন্ড্রমে কি ওষুধ দেয়া হয়?
স্টেরয়েড দিয়েই বাচ্চাদের নেফ্রটিক সিন্ড্রমে চিকিৎসা করা হয়। এটাতেই রোগ রিমিশনে আসে।
তবে কখনও কখনও স্টেরয়েয়েড একা কাজ না করলে সাইক্লোফসফামাইড বা সাইক্লোস্পোরিন দিতে হয়।
এসিই ইনহিবিটর বা এসিই ইনহিবিটর রিসেপ্টর ব্লকার দিয়ে প্রটিনোরিয়া বা প্র¯্রাব দিয়ে প্রটিন বের হয়ে যাওয়া কমানো যায়।

ডাই ইরেটিকস্ দিয়ে প্র¯্রাব বাড়ানো যায়।
প্রটিন খুব বেশী কমে গেলে শিরায় এলবুমিন দিতে হয়।
কখনও কখনও প্রেসার কমানোর ওষুধ ও কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ প্রয়োজন হয়।
নেফ্রটিক সিন্ড্রম কি প্রতিরোধ করা যায়? না এটা প্রতিরোধ করা যায় না। তবে খাবারে পরিবর্তণ এনে আর চিকিৎসা করে শরীরে পানি আসা আর কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করা যায়।

 

ডা. জহুরুল হক সাগর

নবজাতক-শিশু-কিশোর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
রূপসী বাংলা হাসপাতাল,
জিয়া সরনী, শনির আখরা, কদমতলি, ঢাকা।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.