মাসিক বা পিরিয়ডের ব্যথা হওয়া একটি কমন ঘটনা। এটি মাসিক চক্রের একটি স্বাভাবিক অংশ। বেশিরভাগ নারীই জীবনের কোনো এক সময়ে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। পৃথিবীজুড়ে ১৭ কোটি ৬০ লাখ নারী এন্ডোমেট্রিওসিসের ভয়ানক বিব্রতকর ব্যথায় ভুগছেন। কার্ল ভন রকিটানস্কি ১৮৬০ সালে নারীর জরায়ুর অংশ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের (মাইক্রোস্কোপ) নিচে দেখে এই ব্যাধির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেন। পিরিয়ডের সময় এলেই সবচেয়ে বেশি ভয় থাকে ব্যথা নিয়ে। অনেকেই ভোগেন ডিসমেনোরিয়ায়। তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে কোমর, ঊরু ও পা পর্যন্ত। পিরিয়ড চলাকালীন অসহ্য যন্ত্রণার অন্যতম কারণ হতে পারে জরায়ু মোটা এবং আয়তনে বড় হয়ে গেলে।

এ সময় কোমর, তলপেটে অসহ্য ব্যথাতে কাহিল হয়ে পড়েন অনেক মহিলা। ব্যথা বাড়তে বাড়তে সারা শরীরের ছড়িয়ে পড়ে। ১২ বছরের কিশোরী হোক কিংবা ৪২ মধ্যবয়স্কা পিরিয়ডের যন্ত্রণা সইতে হয় অনেককেই।
কী কারণে হয় এই অসহ্য যন্ত্রণা?

পিরিয়ড চলাকালীন অসহ্য যন্ত্রণার অন্যতম কারণ হতে পারে জরায়ু ভিতরের আবরণ মোটা এবং আয়তনে বড় হয়ে গেলে। এর পোশাকী নাম অ্যাডেনোমায়োসিস। নারী দেহের প্রথম পরিবরর্তন শুরু হয় কৈশোরকালে, পিরিয়ড শুরু হওয়ার মাধ্যমে। মোটামুটি বেশিরভাগ মেয়েকেই পিরিয়ড চলাকালীন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারম ব্যথা বলে চার পাঁচদিন কাটিয়ে দেয় মেয়েরা। মায়েরাও বিশেষ গুরুত্ব দেন না। বরং ব্যথা সহ্য করার পরামর্শ দেন। কিংবা ব্যথা কমাবার ঘরোয়া পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু এই অতিরিক্ত যন্ত্রণা যে বড়সড় রোগের পূর্বাভাস হতে পারে তা বেশিরভাগ মহিলাই গ্রাহ্য করেন না।

অ্যাডেনোমায়োসিস-এর লক্ষণ:

অল্প থেকে মারাত্মক একেক ধাপে অ্যাডেনোমায়াসিসের লক্ষণ হতে পারে একেক রকম। যদিও তার কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ রয়েছে।
– অতিরিক্ত এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা ঋতুস্রাব
– পিরিয়ড চলাকালীন তলপেটে ভয়ানক যন্ত্রণা এবং খিঁচুনি
– ইন্টারকোর্সের সময় যন্ত্রণা
– পিরিয়ডের নির্দিষ্ট সময়ের মাঝেই হঠাৎ রক্তপাত শুরু হয়ে যাওয়া
– পেটে চাপ এবং ফুলে যাওয়া
– জরায়ুতে প্রদাহ
– অ্যানিমিয়া
– প্রজনন ক্ষমতা লোপ
– প্রসারিত জরায়ু

অ্যাডেনোমায়োসিস বনাম এন্ডোমেট্রিয়োসিস:

অ্যাডেনোমায়োসিস এবং এন্ডোমেট্রিয়োসিস উভয়েই এন্ডোমেটিরিয়াল কলার অসুখ। অতএব এই দুটি একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এমনকি উভয়ের লক্ষণগুলিও প্রায় একইরকম। তা সত্ত্বেও এই দুইয়ের মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে তা হল এন্ডোমেটিরিয়াল কলার বৃদ্ধি।

এন্ডোমেট্রিয়োসিস- এন্ডোমেট্রিয়োসিস অবস্থা হল যখন এন্ডোমেটিরিয়াল কোষগুলি নির্দিষ্ট স্থানের পরিবর্তে বাইরে যেমন তলপেট, পেলভিস, ওভারি কিংবা গর্ভে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

অ্যাডেনোমায়োসিস- অ্যাডেনোমায়োসিস অবস্থা হল যখন কোষগুলি জরায়ুর দেওয়ালে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তবে যাই হোক না কেন উভয় সমস্যার জন্যই পিরিয়ড চলাকালীন ভয়ানক যন্ত্রণা হতে পারে। অথবা চলতে পারে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। আবার কথনও যন্ত্রণা এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ চলতে পারে একসঙ্গেও।

অ্যাডেনোমায়োসিসের চিকিৎসা:

অ্যাডেনোমায়োসিসের লক্ষণের উপর তার চিকিৎসা নির্ভর করে। এছাড়াও মেনোপোজে সময়ের উপরও এর চিকিৎসা নির্ভর করে। মেনোপোজের পর অ্যাডেনোমায়োসিসের সমস্যা ধীরে ধীরে কমে যায়। এক্ষেত্রে ডাক্তাররা অনেক সময় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটারি ওষুধ খাওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়াও নানা হরমোনাল চিকিৎসা যেমন- ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টিনের উৎপাদন কম, হরমোনযুক্ত প্যাচ, কিংবা ভ্যাজাইনাল রিং পরার পরামর্শ দেন চিকিৎকরা। ব্যথার জন্যও নির্দিষ্ট ওষুধ দেওয়া হয়। তবে যন্ত্রণা যদি মাত্রা ছাড়িয়ে একেবারে অসহ্য হয়ে ওঠে তখন চিকিৎরা জরায়ু বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন।

ব্যথা কমিয়ে সাময়িক আরামের জন্য বেশ কয়েকটি ঘরোয়া পরামর্শ অবলম্বন করা যেতে পারে। এই পরামর্শ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন। এ ছাড়াও নিচের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে-
অনিয়মিত মাসিক
দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে রক্তক্ষরণ
যোনিপথে ঘন ও দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব যাওয়া
যৌন সহবাসের সময়ে ব্যথা হওয়া
মাসিক চলাকালে ব্যথা হওয়ার পাশাপাশি এসব লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ব্যথা কমানোর ঘরোয়া পরামর্শ :

– তলপেটে গরম পানির সেঁক দিন। এক্ষেত্রে আইসব্যাগে গরম পানি ভরে নিতে পারেন।
– মাসাজ করলে শরীরের ব্যথা অনেকাংশে কমে যায়
– খাবারে পুষ্টিকর জিনিস রাখুন। তেল, মশলাদার খাবার, ফাস্টফুড বন্ধ করে দিন
– আদা এবং মধুর মিশ্রণ খান
– গরম দুধে হলুদ মিশিয়ে পান করুন
– ডায়েটে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম রাখুন
– উষ্ণ গরম পানিতে গোসল করুন।

পরিশেষে বলতে চাই, সুস্থ জীবনযাপন খুবই জরুরি। খেলাধুলো বা শরীরচর্চা দরকার। দুগ্ধজাত দ্রব্য, রেডমিট, কফি, গম থেকে তৈরি খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। মানসিক চাপ কমাতে হবে। অনেক সময় এন্ডোমেট্রিওসিসের কষ্ট সহ্য করতে করতে বিষাদগ্রস্ততা হতে পারে। পরিবারের লোকজনের সহমর্মিতা দরকার। আর পিরিয়ডের ব্যথায় না বুঝে ওষুধ খাওয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকি যেগুলো ফিজিওলজিক্যাল প্রবলেম, সেক্ষেত্রে ব্যথার ওষুধ খেলে হবে না। চিকিৎসা করতে হবে। প্যাথোলজিক্যাল সমস্যা হল এবং সে পেইনকিলার মাসে পাঁচ থেকে ছয়দিন খেয়েই গেল, সেক্ষেত্রে কিডনির সমস্যাও হতে পারে। নারীরা পিরিয়ডে বা যৌন সংসর্গে তীব্র ব্যথা হলে গোপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.