বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত, দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো একজন যুবক বা মধ্যবয়সী লোকের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। বাচ্চা বা নবজাতকদের জন্য আরও অনেক বেশি। যুবক বা মধ্যবয়সী কারও জন্যই দিবানিদ্ৰা সুখকর, স্বস্তিদায়ক বা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
আমাদের একজন অধ্যাপক কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে স্বল্পকালীন চাকরির পর অবসর নিয়ে বেসামরিক চাকরিতে চলে আসেন। তিনি দিনে ঘুমাতেন বলে, তার কর্মস্থলে সহযোগীরা তাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন ‘He is Dr. X, who sleep both at day & night’.
এমনিতেই আমরা জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। উনার মুখ থেকেই আমি এ কথা শুনেছি। যাই হোক দিবানিদ্রা অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক না হলেও মঙ্গলজনক নয়। তাহলে কীভাবে আপনি আপনার দিবানিদ্রাকে পরাস্ত করতে পারেন—
১. স্মার্টফোন : স্মার্টফোন বা যে কোনো মোবাইল ফোন আপনার নিদ্রাকে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, যদি আপনি ঘুমের সময় বা তার আগে ব্যবহার করেন। এটা কোনো ব্যাপার না, কতক্ষণ আপনি ব্যবহার করলেন। তবে গবেষণা করে দেখা গেছে, যে যতবেশি স্মার্টফোনের ব্যবহার করেছে, তার ঘুমের গুণগত মানও অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে। সম্ভবত এটা উপযুক্ত সময় এসে গেছে ঘুমের সময় মোবাইল ফোন বেডরুম থেকে সরিয়ে ড্রইংরুম বা অন্য কোনো স্থানে চার্জে ফেলে রাখা।
২. এনার্জি ড্রিংক : গবেষণায় পরিলক্ষিত হয়েছে, স্বল্পমাত্রার ক্যাফিনযুক্ত এবং অতিরিক্ত মাত্রার চিনি-মিশ্রিত যে-কোনো পানীয় আপনাকে সহজেই নিদ্রাচ্ছন্ন করে তুলতে পারে, যা কখনো তৃপ্তির ঘুম আনতে পারে না। তাই পানি বা মিনারেল ওয়াটার ছাড়া অন্য কোনো পানীয় প্রাধিকার পাওয়া উচিত নয়। অধিকন্তু বাচ্চারা যারা অতিরিক্ত পরিমাণে কোক, ফান্টা বা সেভেন আপ জাতীয় পানীয় পান করে, তারা শুধু অতিরিক্ত চিনি খাচ্ছে না, তারা কার্বোনেটেড সুগার খাচ্ছে যা কিনা কার্সিনোজেন (Carcinogen) অর্থাৎ ক্যানসারের সহায়ক। পৃথিবী সৃষ্টির পরে নষ্ট জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য দুটো উপাদান আমাদের দিয়েছেন, যা কিনতে হয় না বরং আমাদের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। তার একটি হলো পানি, অপরটি বায়ু বা অক্সিজেন।
৩. অতিরিক্ত খাবেন না : ট্রিপটোপেন একটা রাসায়নিক উপাদান যা মাংস, মাছ, ডিম, দই এবং পনিরে যথেষ্ট থাকে, এমনকি সয়াবিনেও এর পরিমাণ কম নয়। অতিমাত্রায় ট্রিপটোপেন শরীরের লেখাপ্তি (Lethargy) বা অবসন্নতা ঘটাতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হলো অতিরিক্ত মাত্রায় শর্করাযুক্ত খাবার শুধু মুটিয়ে দেয় না, অলসতা সৃষ্টি করতেও সহায়ক।
৪. চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন : চর্বিযুক্ত খাবার সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। চর্বিযুক্ত ভাজা খাবার দিবাশিরায় আপনাকে টেনে নিতে পারে। নৈশভোজে খাবার পরিমাণ সামান্য বেশি হলে অথবা আপনি পর্যাপ্ত মুটিয়ে গেল রাত্রিবেলায় নাক ডেকে ঘুমাতে পারেন। যারা নাক ডেকে ঘুমান, তাদের কখনো স্বাচ্ছন্দ্যে নিদ্রা হয় না অর্থাৎ অক্সিজেনের পরিমাণ রক্তে সে পরিমাণ থাকে না। বরং স্নায়ুকোষগুলো অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগে বলে দিবালোকে ক্লান্তিবোধ বা ঘুমঘুম ভাব একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। রাতের খাবার হালকা হওয়াই ভালো এবং খাবারের ন্যূনতম দু-ঘণ্টা পরে বিছানায় যাওয়া উচিত। তাতে করে অ্যাসিড রিফ্লাক্স হয় না অর্থাৎ বুক জ্বালা করে না।
৫. সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি : অতিমাত্রায় ফেইসবুক ব্যবহার, ফেইসবুক অথবা যে কোনো সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারকারীদের জন্য যেমন দুঃসংবাদ আছে, তেমনি সুসংবাদও অপেক্ষমাণ। সুসংবাদ হলো দীর্ঘ বন্ধুসার্কেল এবং নতুন নতুন যোগাযোগ, সামাজিক সচেতনতা এবং তথ্য আদানপ্রদান। খারাপটা হলো, বাস্তব জগতের বাইরে অবস্থান করা, অসামাজিক আচরণ, দুশ্চিন্তা এবং Cyber bullying. যদিও কোনো কোনো গবেষণা ইঙ্গিত করছে, ফেইসবুক ব্যবহারকারীরা দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। যাই হোক না কেন, রাত্রির নিদ্রার বিঘ্ন ঘটায়, দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন হবার ভয় থাকছেই। একই সাথে ঘুমের বিঘ্নজনিত কারণে, রক্তচাপ বৃদ্ধি এবং রক্তচাপ বৃদ্ধিজনিত জটিলতা অর্থাৎ উচ্চরক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি অনেক মানসিক জটিল রোগের সৃষ্টি করতে পারে সোশ্যাশ মিডিয়ার আসক্তি।
৬. ব্যায়াম বা শরীরচর্চা : সান্ধ্যকালীন সামান্য ব্যায়াম যা শরীর থেকে ঘাম নির্গত করে, যা শারীরিক চাহিদা মেটায়, তা আপনাকে সন্তোষজনক রাত্রের নিদ্রায়, শাস্তি এনে দিলে, দিবানিদ্রার ভয় থাকে না
তদুপরি শান্তিপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ ঘুমের জন্য সন্ধ্যায় মাঝারি ধরনের ব্যায়াম, কম পরিমাণে খাবার এবং খাবারের ন্যূনতম দেড় ঘণ্টা আগে ঘুমাতে না যাওয়া, পরিপূর্ণ অন্ধকার কক্ষ, বাহিরের কোলাহল বা শব্দমুক্ত পরিবেশ আপনাকে রাত্রির শাস্তিদায়ক ঘুমে সাহায্য করলে, দিবান্দ্রিায় আপনি কোনো রকম আকর্ষণ বোধ করবেন না।
সর্বোপরি অস্বাস্থ্যকর ঘুম শুধু যে চোখের স্বাস্থ্য নষ্ট করে তা নয়, গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রনিক অসংক্রমণ রোগের শতকরা ৩০ ভাগ দায়ী বিঘ্ন বা অস্বাস্থ্যকর নিদ্রা। নিদ্রায় যে কোনো ধরনের ব্যাঘাত মস্তিষ্কের সুস্থচিস্তায় ব্যত্যয় ঘটাতে পারে, এমনকি আবেগ এবং উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে না, ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়, মাঝে মাঝেই হাই ওঠাবেন এবং সাধারণের চেয়ে বেশি Irritable বা উত্তেজিত থাকবেন। সুতরাং চেষ্টা থাকবে যতক্ষণ ঘুমাই, ততক্ষণ যেন স্বস্তির এবং শান্তির ঘুম হয় ।
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
কান, নাক ও গলা বিশেষজ্ঞ এবং হেড নেক সার্জন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল