শীতের সময় পরিবেশটা বেশ খানিকটা ভিন্ন থাকে। ঠান্ডা, ধুলাবালু বেড়ে যাওয়া, পরিবর্তিত আর্দ্রতায় হঠাৎ শরীর খাপ খাওয়াতে গিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে।

আমাদের শরীরের ভেতরে টনসিল, ফ্যারিংস, নাসিকা, গলা—এসব জায়গায় অসংখ্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাপমাত্রা কমে গেলে সেগুলো সক্ষম হয়ে ওঠে। এরপর সংক্রমণ তৈরি করে।

ফ্যারিনজাইটিস

শীতে গলাব্যথা, জ্বর বা খুসখুসে কাশির সমস্যা হয় অনেকের। এসব ফ্যারিনজাইটিসেরই লক্ষণ। এ সময় অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে আর কথা বলতে পারে না। গলাব্যথা, গিলতে অসুবিধাসহ বিরক্তিকর অনুভূতির মুখোমুখি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে এ সমস্যা তৈরি হয়। এ ছাড়া শীতকালে তেষ্টা কম পায়। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে পরদিন ঘুম থেকে ওঠার পর গলা শুকিয়ে গিয়েও ব্যথা হতে পারে।

ফ্যারিনজাইটিস থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো ঠান্ডা এড়িয়ে চলা। যাদের কোল্ড অ্যালার্জি আছে বা শীত এলেই এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাদের শীতের রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে গলায় পাতলা সুতির মাফলার বা কাপড় হালকাভাবে পেঁচিয়ে নিতে হবে। সঠিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে, নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস এবং মুখ থেকে হাত দূরে রাখতে হবে।

ফ্যারিনজাইটিসে হালকা গরম পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। গলাব্যথায় চা অত্যন্ত কার্যকর উপশমকারী। আদা, আদার রস, লবঙ্গ, মধু প্রভৃতি বেশ আরামদায়ক। ঠান্ডা পানি পান করা যাবে না। ফ্যারিনজাইটিসে আক্রান্ত হলে গরম স্যুপ, গরম পানির সঙ্গে লেবু বা মধু মিশিয়ে খেলে বেশ আরাম পাওয়া যায়। অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট এবং ক্ষত নিরাময়কারী হিসেবে মধুর সুখ্যাতি রয়েছে। এতে থাকা উপকারী উপাদানগুলো গলাব্যথা সারিয়ে তুলতে কাজ করে।

এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ওষুধ যথেষ্ট।

গলার সঙ্গে কানের একটা সম্পর্ক আছে। ঠান্ডা থেকে গলাব্যথা হলে কানেও ব্যথা হতে পারে; বিশেষ করে ব্যথা দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে, জীবাণু নাক আর কানে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ জন্য গলাব্যথা এক থেকে দুদিনের মধ্যে না সারলে নাক-কান-গলারোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

গলা ভাঙা

কখনো কখনো ভোকাল কর্ড বা কণ্ঠনালি শীতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। নাসারন্ধ্র থেকে শুরু করে একেবারে ফুসফুস পর্যন্ত একই ঝিল্লি। এর যেকোনো জায়গায় কোল্ড অ্যালার্জির প্রকোপ হলে এটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকেও কণ্ঠস্বর বসে যেতে পারে।
শীতকালে গলা ভিজিয়ে দেওয়ার কাজটা কম হলেই গলা ভেঙে যায়। তার ওপর শীতকালে বাতাস ভারী হওয়ার কারণে ধুলা-ময়লা—সবই বেড়ে যায়। ফলে দূষণের পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে এই সময়ে সাইনাস এবং নাকের সংক্রমণ বেশি হয়। এখান থেকে গলায়ও সংক্রমণ হয়।

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে রাতে বা ভোরে বের হলে কান-মাথা-গলা ঢেকে বের হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আরামদায়ক মাফলার ব্যবহার করা যেতে পারে। শীত কমাতে মোজা পরাও ভালো।

শীতে ঠান্ডা লেগে কণ্ঠস্বর বসে যাওয়ার সমস্যায় গরম পানির ভাপ নিলে উপকার পাওয়া যায়। গরম পানিতে মেনথলের দানা মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাপ নেওয়া যেতে পারে সকালে ও রাতে।

টনসিলের সংক্রমণ 

শীতে ভোগান্তির মধ্যে টনসিলের ব্যথা বেশ পরিচিত সমস্যা। সাধারণত জীবাণুঘটিত সংক্রমণ থেকে টনসিলের যন্ত্রণা হয়। এটি একধরনের লসিকাগ্রন্থি, যা আমাদের গলার ভেতরে শ্বাস ও খাদ্যনালির মুখে অবস্থিত। শীত এলে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবেই তুলনামূলক কিছু কমে যায়। শীতকালে, বিশেষ করে শিশুদের ঠান্ডা পানি ও ঠান্ডা খাবার খাওয়া, অপর্যাপ্ত শীতের পোশাক, দুর্বল স্বাস্থ্য, অপুষ্টি, অ্যালার্জিজনিত সমস্যার কারণে টনসিলের প্রদাহ দেখা দেয়; তবে যেকোনো বয়সীরা আক্রান্ত হতে পারে।

সাধারণত টনসিল ও এডিনয়েডের প্রদাহ ছাড়া টনসিলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য নানান জটিল রোগ হয় শীতকালে। টনসিলের তীব্র সংকমণ হলে গলার উপরিভাগের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায় ও ব্যথা করে। তাই টনসিল ও এডিনয়েডের অসুখ অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। স্ট্রেপটোকক্কাল সোর থ্রোট হলে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

 

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী

এফসিপিএস (ইএনটি), নাক-কান-গলারোগ বিশেষজ্ঞ, হেড-নেক সার্জন, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.