হেপাটাইটিস মানে যকৃত বা লিভারের প্রদাহ। আমাদের দেশে জন্ডিস নামেই সবাই এটাকে চিনে ও জানে। এ রোগ হলে প্রায়ই শরীর, চোখ, হাতের তালু, প্র¯্রাব ইত্যাদি হলুদ বর্ণের হয়ে যায়। এটি সাধারণত বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমনের কারনে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস ভাইরাসের প্রধান টাইপ হলো এ, বি, সি, ডি, ই এবং আরও কয়েকটি। অনেক ভাইরাস সংক্রমনের মতই রুগীকে ভাল সাপোর্ট দেয়াই এর প্রধান চিকিৎসা। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারনেই একসময় ভাইরাস শরীর থেকে চলে যায়, সংক্রমিত লিভার সুস্থ হয়ে আগের মত হয়ে যায়। তবে সংক্রমনের মাত্র বেশী হলে বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে রুগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে ভাল সাপোর্ট দিতে হয়। বমির ওষুধ, শিরার ফ্লুইড, জ্বরের ওষুধ, প্রয়োজনে পেটের স্টেরিলাইজার এন্টিবায়োটিক, রক্তক্ষরণ প্রতিরোধি চিকিৎসা ইত্যাদি দিতে হয়। তবে ৯০% এর বেশী রুগী নিজ থেকেই রোগটিকে প্রতিরোধ করতে পারে। এই ৯০% রুগীকে নিয়েই হাতুড়ে ডাক্তার কবিরাজরা ব্যাবসা ফাদে। হাত ধোয়া, হলুদ পানি বের করা, জন্ডিস ঝাড়ানোর নাম করে রুগীর অপচিকিৎসা চলতে থাকে। এই রুগীদের কেউ কেউ এই অপচিকিৎসার কারনেই খারাপ হয়ে যায়। এমনকি দেরিতে হাসপাতালে আসার কারনে মৃত্যুও হয়। ডাক্তাররাই প্রয়োজন ছাড়া এই রুগীদের কোন ওষুধ দেন না। অন্য দিকে হাতুরেরা বিভিন্ন টোটকা খাইয়ে রুগীর লিভারকে দ্রুত খারাপের দিকে নিয়ে যান।

এ টাইপ ও ই টাইপ হেপাটাইটিস এর উপসর্গ অন্যান্য সাধারন ভাইরাস সংক্রমনের অনুরূপ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১ মাসের মধ্যেই লক্ষণ সমূহ সেরে যায়। এগুলো দিয়ে ক্যান্সার বা সিরোসিস হয় না। হেপাটাইটিস বি ও সি এর কারণে মানুষ হঠাৎ করে অসুস্থ হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও অসুস্থ হতে পারে। হেপাটাইটিস বি ও সি এর কারণে লিভার ক্যান্সার বা গুরুতর ক্রণিক ইনফেকশনের কারণে লিভার সিরোসিসও হতে পারে। তাই এগুলো সনাক্ত হলে বা সন্দেহ হলে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন করলেই কেবল সুস্থ হওয়া সম্ভব। হাতুড়ের চিকিৎসা নিয়ে দেরি করলে এটি আর সম্ভব হয় না।

দূষণের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ছড়ায়:

হেপাটাইটিস এ ও ই, আক্রান্ত ব্যক্তির মল দ্বারা দূষিত খাবার ও পানীয় এর মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়াও হেপাটাইটিস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন: – ডায়াপার পরিবর্তন বা যৌন যোগাযোগর মাধ্যমে। অস্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। হেপাটাইটিস বি ও সি প্রধানতঃ সংক্রমিত ব্লাড, বীর্য বা শরীরের অন্যান্য তরল পদার্থের মাধ্যমে ছড়ায়। একই ব্লেড, রেজর, সূঁই ব্যাবহার করলেও সংক্রমণ হতে পারে।

হেপাটাইটিস এ ও ই-এর ঝুঁকি:

খাদ্য বা পানীয় জলের মাধ্যমে-হেপাটাইটিস এ ও ই ছড়ায়। দূষিত তাজা ফল, সবজি এবং সালাদের মাধ্যমে এর প্রদুর্ভাব দেখা যায়। খোশা ছাড়ানোর আগে বা খাদ্য গ্রহণের পূর্বে খাবার ভালভাবে ধুয়ে নিন। দূষিত পানি পান করেও আপনি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। ট্যাপের পানি পান করার পূর্বে অবশ্যই সিদ্ধ করে নিতে হবে। ঘরের বাহিরে বোতলজাত পানি পান এবং বরফ এড়িয়ে চলা উচিত, যদি তা বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি করা না হয়। তবে আশার কথা হল হেপাটাইটিস এ ও বি এর ভ্যাকসিন নেয়া যায়, যা আমাদের এই দুটি ছাড়াও বি এর সাথে ডি থেকেও সুরক্ষা দিতে পারে।

অপরিষ্কার হাত:

হেপাটাইটিস এ দেহের বাহিরে একমাস টিকে থাকতে পারে। সবসময় ভাল স্বাস্থ্যবিধি- টয়লেট ব্যবহার, ডায়াপার পরিবর্তনের পর এবং খাদ্য নাড়া চাড়া বা খাবার গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই সাবান পানি বা জীবাণু নাশক দিয়ে হাত ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে, যাতে করে হেপাটাইটিস এ এর বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।

দূষিত রক্ত:

সংক্রামিত রক্ত এবং শরীরের তরল হেপাটাইটিস সংক্রামণে সাহায্য করে। জন্মের সময় মায়ের থেকে, যৌন সঙ্গীর মাধ্যমে কিংবা খোলা কোন ক্ষতের মাধ্যমেও এটি ছড়ায়।

হাত, পায়ের নখ বা চুল কাটা:

বিউটি পার্লার বা সেলুনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ও সি সংক্রামিত হওয়ার কিছু ঝুঁকি থাকে। ২% থেকে ৫% ক্ষেত্রে সাজ-সজ্জার আইটেম যেখানে সম্ভাব্য রক্তের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। ঝুঁকি এড়াতে আপনার ব্যক্তিগত নেইল কাটার, কিউটিকল ক্লিপলার, রেজার অন্যান্য বক্তিগত জিনিসপত্র ব্যবহারের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমাতে পারেন।

যৌন যোগাযোগ:

হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত কোন সঙ্গীর সাথে যৌন মিলনের মাধ্যমে এটি আক্রান্ত হবার প্রধান কারণ হতে পারে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির রক্ত, যোনি তরল বা বীর্যের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। স্বল্প সময়ের জন্য বিরত থাকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে আক্রান্ত এড়ানোর সবচেয় নিরাপদ উপায়। এছাড়াও কনডম ব্যবহারেও ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করবে।

ব্যক্তিগত সামগ্রীর ব্যবহার:

হেপাটাইটিস বি ও সি আক্রান্ত কারো ব্যক্তিগত জিনিস ব্যবহারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। এগুলোর মধ্যে টুথব্রাশ, রেজার, নেইল কাটার, সূঁচ বা অন্য কোনভাবে সংক্রামিত রক্তের সংস্পর্শে মিশে আক্রান্ত হয়। আপনার নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এ সকল সামগ্রী রাখুন অন্য কারো সাথে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।

 

ডাঃ ফাওয়াজ হোসেন শুভ

কনসালটেন্ট, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি এন্ড হেপাটোলজি।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.