আজ বিশ্ব দৃষ্টি দিবস। ২০০০ সালের এই দিনে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি দিবস পালিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় আন্তর্জাতিক অন্ধত্ব দূরীকরণ সংস্থার (IAPB) পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘কর্মক্ষেত্রে আপনার চোখকে ভালোবাসুন’ (Love your eyes at work)।

আপনার কাজের ধরণ এবং প্রকৃতি যাই হোক না কেনো, চোখের যত্ন ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণই এবারের উপজীব্য বিষয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি মানুষ স্থায়ী অন্ধত্বের শিকার। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ আছেন চীন, ভারত এবং সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে। বিশ্বে ২৫ কোটি মানুষ নিরাময়যোগ্য অন্ধত্বে আক্রান্ত। যার ৮০ শতাংশ সঠিক পরিচর্যা এবং সুচিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব।

নবজাতক এবং প্রাক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্মগত ছানি, রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিম্যাচ্যুরিটি (ROP), রেটিনোব্লাস্টোমা, রাতকানা, এমব্লায়োপিয়াসহ (Amblyopia) নানা রোগ অন্ধত্বের জন্যে দায়ী। তাই জন্মের পর শিশুর চোখের পরিপূর্ণ স্ক্রিনিং অত্যন্ত জরুরি। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের শতকরা ৭ ভাগ ক্ষীণদৃষ্টিজনিত উপসর্গে ভোগে।  এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে চোখের সমস্যার চিহ্নিতকরণ এবং রেফারাল পদ্ধতিতে চিকিৎসার দ্বারা নিরাময় সম্ভব। পূর্ণবয়স্ক মানুষেরা চোখের ৫টি রোগ যেমন- চোখের ছানি, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি, গ্লুকোমা, চোখের প্রতিসরণজনিত ত্রুটি, ট্রাকোমা এবং অংকোসারকায়াসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।

বাংলাদেশে চোখে অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ ছানি পড়া এবং এ সংক্রান্ত জটিলতা। চোখের লেন্স বা আবরণ ঘোলা হয়ে যাওয়াকে ছানি বলা হয়। কাঁচ যেমন অস্বচ্ছ হয়ে গেলে আর কাঁচের ভেতর দিয়ে কোনো কিছু দেখা যায় না, তেমনি চোখের লেন্স যদি অস্বচ্ছ হয়ে যায়, চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। চোখে ছানি পড়লে সবকিছু আস্তে আস্তে ঘোলা বা অস্বচ্ছ দেখা যায়।

চোখের যত্ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।

সাধারণত ষাটোর্ধ নারী–পুরুষের চোখে ছানি পড়তে দেখা যায়। তবে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, চোখে আঘাত, বিভিন্ন প্রদাহসহ নানান কারণে অল্প বয়সেই চোখে ছানি দেখা দেয় যায়। ছানি পড়ার একমাত্র চিকিৎসা ইন্ট্রা অকুলার লেন্স (IOL) ইম্পল্যান্টেশন। ১৯৪৯ সালের ২৯ নভেম্বর ব্রিটিশ চক্ষু চিকিৎসক স্যার নিকোলাস হ্যারল্ড রিডলীর হাত ধরে যুগান্তকারী এই অপারেশনের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ফ্যাকোইমালসিফিকেশন ছানি জটিলতায় আধুনিকতম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ফ্যাকো মেশিনের আল্ট্রাসনিক শক্তির মাধ্যমে ছানি পড়া লেন্সকে গলিয়ে বের করে ফোল্ডেবল বা নরম কৃত্রিম লেন্স বসানো হয়।

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অন্ধত্বের কারণ। এর ফলে ভিট্রিয়াসে রক্তক্ষরণ, রেটিনার ট্র্যাকশনাল ডিটাচমেন্ট, নিওভাস্কুলার গ্লুকোমা, ইশকেমিক অপ্টিক নিউরোপ্যাথি ইত্যাদি দেখা দেয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, সঠিক সময়ে লেজার চিকিৎসা ও ভিট্রেক্টমি অপারেশনের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব জটিলতা ও অন্ধত্ব গোঁড়াতেই নির্মূল করা যায়।

এ ছাড়া গ্লুকোমা চোখের একটি নীরব ঘাতক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চল্লিশোর্ধ্ব নারী-পুরুষের শতকরা ৩ জন এ রোগে আক্রান্ত হন। যেকোনো কারণে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গ ছাড়াই মারাত্মক দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দেয়। অনেক শিশু এই রোগ নিয়েও জন্মায়। প্রাথমিক অবস্থায় গ্লুকোমা স্ক্রিনিং করে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে গ্লুকোমাজনিত অন্ধত্বের হার হ্রাস করা যায়।  প্রাক বিদ্যালয় বয়সে শিশুর ভিশন স্ক্রিনিং, কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোম এড়াতে কাজের সময় ২০ মিনিট পরপর ২০ সেকেন্ডব্যাপী দিগন্তে দৃষ্টিপাতসহ (২০-২০ রুল) নানা ব্যায়ামের মাধ্যমে চোখের চিকিৎসা দিন। নিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব প্রতিরোধ করুন।

 

লেখক:

ডা. নুসরাত সুলতানা শিমু

সেইফওয়ে আই এন্ড ডেন্টাল হাসপাতাল, মুগদা, ঢাকা

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.