বিশ্বে বর্তমানে অসংক্রামক রোগের নীরব সুনামি চলছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে প্রতি বছর প্রায় ৩৬ মিলিয়ন (৩ কোটি ৬০ লক্ষ) মানুষ অসংক্রামক রোগের কারণে মারা যাবে। অসংক্রামক রোগ যেমন– ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগসমূহে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কায়িক পরিশ্রমহীন কাজ, মানসিক চাপ, অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলোকে। অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্রদের মধ্যে অসংক্রামক রোগ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং ১৫-৬৪ বছর বয়সের মধ্যে অসংক্রামক রোগের উচ্চ প্রকোপ রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য শুভ নয়। কারণ দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশই হল, ১৫-৬৪ বছর বয়সের মধ্যে।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের ব্যাপকতা
বাংলাদেশে, ২০১৯ সালে ৮.৪ মিলিয়ন (৮৪ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ ১৫ মিলিয়ন (১ কোটি ৫০ লক্ষ) হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। এটিও অনুমান করা হয়েছে যে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে আরও ৩.৮ মিলিয়ন লোক প্রি–ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছিল। একটি মেটা-বিশ্লেষণ এবং জাতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদনসহ গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ এর ব্যাপকতা
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ন্যাশনাল ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে, ২০১৭-২০১৮, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ, সচেতনতা, চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণের উপর একটি সমীক্ষায় এটি প্রকাশ পেয়েছে যে উচ্চ রক্তচাপের সামগ্রিক ব্যাপকতা ছিল ২৬.২% (পুরুষ: ২৩.৫%, মহিলা: ২৮.৯%)। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের মধ্যে ৩৬.৭% জানতেন তাদের উচ্চ-রক্তচাপ ছিল এবং শুধুমাত্র ৩১.১% অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ গ্রহণ করেছিল। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের মধ্যে ১২.৭% এর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত ছিল, এবং উচ্চ রক্তচাপের জন্য চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৪৩.৬%।

বাংলাদেশে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ব্যাপকতা
বাংলাদেশী প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ব্যাপকতা সম্পর্কিত একটি গবেষণার মেটা-বিশ্লেষণ প্রকাশ হয়েছে: বাংলাদেশে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ব্যাপকতা ছিল ৫.০%। গ্রামীণ এলাকার (২%) এর তুলনায় শহরাঞ্চলে (৮%) এর মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ব্যাপকতা বেশি ছিল। যাই হোক, লিঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি (পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্য ৩%)।

বাংলাদেশে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এর কারণে মৃত্যুর হার
২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে করোনারি হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা ১,০৮,৫২৮ বা মোট মৃত্যুর ১৫.১৬%। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে হৃদরোগে মৃত্যুর হার পুরুষদের ৩৫ গুণ এবং মহিলাদের জন্য ৪৮ গুণ বেড়েছে।

বাংলাদেশে ব্রেইন স্ট্রোকের ব্যাপকতা
বাংলাদেশে স্ট্রোকের ব্যাপকতা এবং ঝুঁকির কারণগুলির উপর দেশব্যাপী একটি জরিপ থেকে জানা যায় – বাংলাদেশে গত এক দশকে স্ট্রোকের ব্যাপকতা চারগুণ বেড়েছে। কারণ ২০২১ সালে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় ১১.৩৯ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বোচ্চ হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। বয়স্ক এবং পুরুষ জনসংখ্যার মধ্যে ব্যাপকতা অনেক বেশি ছিল। পুরুষদের মধ্যে ব্যাপকতা দ্বিগুণ ছিল। তিন চতুর্থাংশেরও বেশি ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়েছিল। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল, ধূমপান বা তামাক ব্যবহার, ডায়াবেটিস, ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক রোগীদের মধ্যে দেখা ঝুঁকির কারণ।

বাংলাদেশে ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর হার
২০১১ সালে প্রতি হাজারে তিনজন এই রোগে ভুগছিলেন, যা বাংলাদেশে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। সরকারীভাবে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর হার, আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে দ্বিগুণ হয়েছে।

বাংলাদেশে ক্যান্সারের ব্যাপকতা
বাংলাদেশে ২০২০ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত মোট পুরুষ ছিল ৮৮,০৭৫ জন, মহিলা ছিল ৬৮,৭০০ জন। এর মধ্যে পুরুষের ঠোট, মুখ গহ্বর ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার ছিল ২৬.৭ %, ফুসফুসের ক্যান্সার ১১.১%, মহিলাদের মধ্যে ১৯% স্তন ক্যান্সার ও ১২% জরায়ু মুখের ক্যান্সার ছিল।

বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা কি করতে পারি?
প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করলে এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমতে পারে, গুরুতর জটিলতার সম্ভাবনা কমাতে পারে, এমনকি কিছু রোগ নিরাময় করাও সম্ভব। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাথমিক ও দ্বিতীয় স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দিকে কম মনোযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের এই সুনামির মোকাবেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিশ্রুতি সহকারে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিকে ওষুধ, সরঞ্জাম, দক্ষ জনবল এবং একটি কার্যকরী রেফারেল সিস্টেম সহ গড়ে তোলা প্রয়োজন।

তিনটি পদক্ষেপের মাধ্যমে ৭০% অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

১. প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয়,

২. সময় মত চিকিৎসা করা,

৩. নিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা।

‘জীবন অমূল্য’ সুস্থ থাকুক – বাংলাদেশ। আপনার ভবিষ্যতের সুস্থতার জন্য নিজের যত্ন নিন। যা সহজ সাশ্রয়ী এবং স্মার্ট।

 

লেখক:

ডা. এ কে এম আরিফ উদ্দিন আহমেদ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিভাগীয় প্রধান, মাস্টার হেলথ চেকআপ অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস, চট্টগ্রাম

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.