সাধারণত আমরা অসুস্থ হলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই কিংবা হাসপাতালে যাই। আমরা মনে করি, মেডিকেল সংক্রান্ত বিষয় কিংবা অসুস্থতার বিষয়ে আমরা কথা বলবো, যখন আমরা অসুস্থ হব। কিন্তু আমাদের এই ধারণা কি সঠিক? আমরা অসুস্থ না হলেও আমাদের স্বাস্থ্যের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়ার কি প্রয়োজন নেই? আমার কোন অসুখ হতে যাচ্ছে কিনা, কিংবা আমি কোন একটা অসুখের কোন একটা পর্যায় অতিক্রম করছি কিনা তা কি আগে থেকে দেখে রাখা যায়? আর আগে থেকে যদি নিজের অসুস্থতার বিষয়ে জানা যায় তবে, চিকিৎসা নেওয়াও সহজ হয়, এবং চিকিৎসা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আমরা সবাই স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার চাইতেও রোগ হলে চিকিৎসা নেওয়ার উপর বেশি গুরুত্ব দেই। কিন্তু রোগের চিকিৎসা করাই স্বাস্থ্যরক্ষার একমাত্র উপায় নয়। আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিই তাহলে আমাদের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম হবে এবং রোগের চিকিৎসা করাও সহজ হবে। আমরা বিশ্বাস করি, একজন সত্যিকারের নিরাময়কারী, নিরাময় করার প্রয়োজন হওয়ার আগেই, নিরাময় করার ব্যবস্থা করে।
জীবন মহামূল্যবান এবং আপনার সবকিছুর বিনিময়েও আপনার জীবনের হারিয়ে যাওয়া মূহুর্ত ফিরে পাবেন না। তাই আপনার রোগ প্রতিরোধ এর জন্য আপনাকে কি কি করতে হবে তা জানা খুব জরুরি:
২. স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা গ্রুপগুলো কি তা জানতে হবে।
৩. প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্নয়ের জন্য কোন ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা আপনার আছে কিনা।
৪. নিয়মিত আপনার স্বাস্থ্যের যত্নে কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা।
চিকিৎসা মূলত দুইভাবে নেওয়া যায়। এক হল প্রতিরোধকারী চিকিৎসা আর অন্যটি হল উপশমকারী চিকিৎসা।
আমাদের জীবনাচরণে, চলাচলে, আমরা এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারি যাতে কিছু কিছু অসুখ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারবো। আমরা সুষম ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে অনেক রোগ থেকেই মুক্ত থাকতে পারি। প্রতিরোধকারী চিকিৎসাই হল সারা বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন মূল আলোচ্য বিষয়। এবং ভবিষ্যতে এই চিকিৎসা পদ্ধতিই আমাদের মূল অবলম্বন হবে।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপ সমূহ:
১. প্রারম্ভিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা: শিশু বয়সে ক্ষতিকারক জীবনাচরণ থেকে নিবৃত করা। যেমন পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম করা ইত্যাদি।
২. প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা: স্বাস্থ্য সচতনতা মূলক শিক্ষা, পরিবেশ সংক্রান্ত সাবধানতা, খাদ্য ও ঔষধ গ্রহনে সাবধানতা, কাজের পরিবেশে সাবধানতা, টিকা গ্রহণ, রোগ প্রতিরোধী ঔষধ সেবন ও খাদ্য গ্রহণ।
৩. দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা: নিয়মিত স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্নয় করা যায় এবং চিকিৎসা দিয়ে রোগ ভাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৪. তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা: যেকোন রোগ নির্নয় হলে উপযুক্ত চিকিৎসা নেওয়া ও রোগ সংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার ব্যবস্থা করা।
আমরা কিছু রোগীর উদাহরণ দেখি:
১. একজন রোগী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত এবং তার ক্যানসার ধরা পড়লো চতুর্থ পর্যায়ে।
২. একজন রোগী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, কিন্তু তার ডায়াবেটিস ধরা পড়লো কিডনী সমস্যা শুরু হওয়ার পর।
৩. ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শরীরের বাম পাশটা অবস হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ধরা পড়লো রোগীর উচ্চ রক্তচাপ ছিল।
৪. হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালে সিসিইউতে ভর্তি হওয়ার পর জানা গেল তার কোলেস্টেরলের পরিমান ছিল অনেক বেশি।
উপরোক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্থাৎ নিয়মিত স্ক্রিনিং পরীক্ষা করা হলে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়া যেত। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই উচিত বছরে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
বিশ্বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বর্তমান মূল চ্যালেঞ্জ হল– উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারন করে, জনজীবনে তা কার্যকর করা, যার মাধ্যমে মানুষ রোগ মুক্ত থাকতে পারে। এ বিষয়েই এখন বিভিন্ন গবেষনা চলছে।
রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মূলত দুই ধরনের রোগ নিয়েই ভাবতে হয়।
১. সংক্রামক রোগ (যা, জীবাণু দিয়ে হয়, এবং একজন থেকে অন্য জনে সংক্রমিত হতে পারে।)
২. অসংক্রামক রোগ (যা, এক জন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারেনা।) যেমন: ডাইয়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, ক্যানসার এবং দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে মূলত ব্যাক্তি পর্যায়ে ও সামাজিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিধি সমূহ মেনে চলা (যেমন সঠিক নিয়মে হাত ধোয়া, শারীরিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, আশেপাশের পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্ত রাখা, উপযুক্ত স্থানে বর্জ্য নিষ্কাশন, পরিষ্কার পানি পান করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া), যে সব রোগের টিকা রয়েছে তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা, রোগ হলে দ্রুত চিকিৎসা করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
অসংক্রামক রোগ (যেমন: ডাইয়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগ) প্রতিরোধে গুরুত্ব দেওয়া হলে এই সকল রোগের কারনে মৃত্যু হার কমে আসে।
লেখক:
ডা. এ কে এম আরিফ উদ্দিন আহমেদ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিভাগীয় প্রধান, মাস্টার হেলথ চেকআপ অ্যাপোলো ইমপেরিয়াল হসপিটালস, চট্টগ্রাম