বাসার চটপটে শিশুটি হঠাৎ অসুস্থ হলে পরিবারের চিন্তার অন্ত থাকে না। অসুস্থ শিশুর চিন্তায় সকলেই দুর্ভাবনায় দিন কাটায়। এ ক্ষেত্রে শিশুর চোখের অসুখ বিশেষ ভাবনার জন্ম দেয়। শিশুর দৃষ্টিশক্তি ক্রমবিকাশমান। চোখের নানান অসুখে এই দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুরুতেই শনাক্ত করা গেলে এই ক্ষতি রোধ করা যায়।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর দিকে নজর রাখতে হবে—
এমব্লায়োপিয়া: জন্মের প্রথম ৬ মাসের মধ্যে শিশুর এক চোখে বা দু’চোখেই দৃষ্টিশক্তির স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। ছয় বছর পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান হারে শিশুর এই দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। এরপর এমব্লায়োপিয়া সাধারণত আর দেখা যায় না। এমব্লায়োপিয়ার কারণ হিসেবে স্কুইন্ট, টোসিস এবং ছানিজনিত অন্ধত্ব দেখা দেয়।
স্কুইন্ট বা বাঁকা চোখ: আমাদের সমাজে বাঁকা বা ট্যারা চোখকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আদতে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। এটি শনাক্ত খুবই সহজ। শিশুর চোখের মণিই সংকটটি সম্পর্কে বার্তা দেয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৪ ভাগ শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। জন্মগতভাবে চোখের স্নায়ুতে দুর্বলতা (ক্রেনিয়াল নার্ভ ৩, ৪, ৬) অথবা গঠনগত অসামঞ্জস্যতার কারণে দুচোখ একসাথে কোনো বস্তু দেখতে পায় না। বরং একটি চোখ অপরটি থেকে দূরে সরে গিয়ে নাক অথবা কানের দিকে বেঁকে যায়। জন্মের এক থেকে দুই বছরের মধ্যে ট্যারা চোখের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে স্থায়ী অন্ধত্ব দূর করা যায়।
ছানিজনিত অন্ধত্ব: জন্মগত কিংবা আঘাতজনিত কারণে শিশুর চোখের লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, মায়ের শরীরে ভিটামিন এ, ডি, ই, কে—এর স্বল্পতা এবং রুবেলা ভাইরাসের সংক্রমণ গর্ভের শিশুর জন্মগত ছানির কারণ। শিশুর চোখে ছানি একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং জটিল রোগ, যার একমাত্র চিকিৎসা অস্ত্রোপচার। সঠিক সময়ে অস্ত্রোপচার করা না হলে শিশুর চোখে এমব্লায়োপিয়াসহ স্থায়ী অন্ধত্বের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
নেত্রনালীতে প্রতিবন্ধকতা: চোখের ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড থেকে অবিরাম পানি নিঃসৃত হয়। এই পানি নাকের দুপাশে অবস্থিত নেত্রনালীর মাধ্যমে শোষিত এবং ভেতরের দিকে প্রবাহিত হয়। শিশুর জন্মের পর অনেক ক্ষেত্রে নেত্রনালী বন্ধ থাকার কারণে চোখ থেকে পানি ঝরতে দেখা যায়। সেই সঙ্গে চোখের কোনায় চাপ দিলে পুঁজ বের হয়ে আসে। জন্মগত কারণে শতকরা ২০ ভাগ শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নাকের দুপাশে নিয়মিত বিরতিতে ম্যাসাজ এবং অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ ব্যাবহারের মাধ্যমে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সাধারণত ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে শিশুর নেত্রনালী আপনা–আপনি খুলে যায়। বিশেষ ক্ষেত্রে প্রোবিং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নেত্রনালীর চিকিৎসা করা হয়।
স্টাই: শিশুর চোখের পাতায় ফুসকুড়ি বা গোটা দেখা দিলে চোখে খচখচে ও ফোলা ভাব হয়। এ ছাড়া চোখের কোনায় ময়লা জমে থাকা, চোখে লালচে ভাব ও প্রদাহসহ অবিরাম পানি ঝরতে দেখা যায়। এটি স্টাই বা চলতি ভাষায় অঞ্জনি নামে পরিচিত। সাধারণত পাপড়ির গোড়ায় জিস এবং মোল নামক গ্রন্থিটি স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে অঞ্জনি সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উষ্ণ জলের সেঁক এবং চোখের নিয়মিত যত্নে ক্ষারবিহীন বেবি শ্যাম্পুর ব্যবহার সাময়িক উপশম পাওয়া যায়।
দৃষ্টিস্বল্পতা বা প্রতিসরণজনিত ত্রুটি: শিশুর দৃষ্টিস্বল্পতা নির্ণয়ে ৬ বছর বয়স হলেই চক্ষু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এ ছাড়া শিশুর আচরণ নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা বাঞ্ছনীয়। যেমন: চোখ কুঁচকে ব্ল্যাকবোর্ড বা হোয়াইট বোর্ডের লেখা দেখার চেষ্টা করা, ১ ফিটের কম দূরত্বে বই পড়া, কাছ থেকে টেলিভিশন দেখা, মাঠে খেলাধুলায় অনীহা, চোখ ও মাথা ব্যথা, চোখ বেঁকে যাওয়া। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শে সুনির্দিষ্ট পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হবে এবং ৬ মাস অন্তর শিশুর চোখ পরীক্ষা করতে হবে।
এ ছাড়া রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি, রেটিনোব্লাস্টোমা, অকুলার মায়োপ্যাথি, ভার্নাল কনজাংটিভাইটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগ নির্ণয়ে জন্মের পরপরই শিশুর চোখের নিয়মিত স্ক্রিনিং নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক:
ডা. নুসরাত সুলতানা শিমু
চিকিৎসক, সেইফওয়ে আই অ্যান্ড ডেন্টাল হাসপাতাল, মুগদা, ঢাকা