মাইগ্রেন একটি স্নায়ুরোগ, যা তীব্র মাথাব্যথার জন্ম দেয়। এটি এমন একটি সমস্যা, যা আপনি প্রায়শই অনুভব করে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে এটি উপেক্ষা করার কারণে গুরুতর আকার ধারণ করে। যা আপনার দৈনন্দিন জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে। মস্তিষ্কে রক্তনালীর অস্বাভাবিক সংকোচন ও প্রসারণের কারণে মাইগ্রেন হয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মাইগ্রালেপসি বা মাইগ্রেনজনিত খিঁচুনি, ফ্যামিলিয়াল হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেন বা মাইগ্রেনজনিত শারীরিক পক্ষাঘাত।

উপসর্গ
শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ মাইগ্রেন শুরুর পূর্ববর্তী লক্ষণগুলো আঁচ করতে পারেন। যেমন: মাথার একপাশে দপদপ করে ব্যথা, বমিভাব, ঘন ঘন বমি, পাতলা পায়খানা, চোখে ঝাপসা দেখা, আলো কিংবা উচ্চ আওয়াজের প্রতি সংবেদনশীলতা। মাইগ্রেন শুরুর প্রথম পাঁচ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ব্যাপী স্থায়ী হয় ‘অরা’। এ সময় দৃষ্টিসীমায় কালো ডট, আঁকাবাঁকা লাইন, আলোর ঝলকানি অথবা কিছুই না দেখতে পাওয়া, কথায় জড়তা, কানে টুং টাং আওয়াজ এবং শরীরে ভারী অনুভূত হয়। মাইগ্রেনজনিত মাথাব্যথা ৪ ঘণ্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ব্যক্তিভেদে মাথার এই ব্যথা ধারাবাহিকভাবে মাসে দু থেকে চারবার অথবা বছরে এক থেকে দুইবার হয়।

কেন হয় 
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারটি কম নিঃসৃত হলে মস্তিষ্কের রক্তনালী অস্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হয়ে মাইগ্রেনের জন্ম দেয়। ডিপোলারাইজেশন তত্ত্ব অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক ডিপোলারাইজেশনের তরঙ্গ মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে (মস্তিষ্কের একটি গ্রন্থি, যা হরমোন নিঃসরণ করে) ছড়িয়ে গেলে ট্রাইজেমিনাল নার্ভটি ক্রিয়াশীল হয় এবং এতে তীব্র মাথাব্যথা দেখা দেয়।

পারিবারিক ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শতকরা ৫০-৭৫ ভাগ শিশু বংশগতভাবে মাইগ্রেনের শিকার। এ ছাড়া চকলেট,পনির, নারকেল, অ্যালকোহল, ক্যাফেইন, দুগ্ধজাতীয় খাবার, জন্মবিরতিকরণ বড়ি, অনিদ্রা, উপবাস, দুশ্চিন্তা ও মানসিক অবসাদ মাইগ্রেনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। নারীদের ক্ষেত্রে মাসিকের পূর্ববর্তী সময়ে মাইগ্রেন দেখা যায়।

প্রকারভেদ
১. ক্লাসিক্যাল মাইগ্রেন: এ সময় মাথায় দপদপ করে ব্যথা হওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টিসীমায় নানা রঙের আঁকাবাঁকা আলোর রেখা দেখা যায়।
২. কমন মাইগ্রেন: এ ক্ষেত্রে এক থেকে দু’দিন তীব্র মাথাব্যথার পাশাপাশি অরুচি ও বমিভাব হয়।
৩. হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেন: বিশেষ এই মাইগ্রেনে মাথাব্যথা ছাড়াও শরীর বা মুখের একটি দিক সাময়িকভাবে অবশ হয়ে আসে।
৪. ক্লাস্টার হেডেক: এ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা একপার্শ্বিক এবং দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী হয়। অ্যালকোহল গ্রহণে এর তীব্রতা বাড়ে।
৫. অফথ্যালমোলজিক মাইগ্রেন: ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। অকুলোমোটর নার্ভ পালসি এ ক্ষেত্রে প্রধানতম কারণ।

চোখের সঙ্গে সম্পর্ক 
রেটিনাল মাইগ্রেনে চোখের রক্তনালী সরু হয়ে যে কোনো এক চোখে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। ফলে আলোর ঝলকানি বা আঁকাবাঁকা আলোর রেখা দৃষ্টিসীমায় ভেসে ওঠে। এ সময় মাথাব্যথা না’ও হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য উপসর্গ, যেমন: মাথা ঘোরা, একটি বস্তুকে দুটো বস্তু হিসেবে দেখা, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে। এ ছাড়া বেসিলার মাইগ্রেন সাধারণত কৈশোরে পরিলক্ষিত হয়। দু’চোখে সাময়িক অন্ধত্বের পাশাপাশি এসময় কানে শো শো আওয়াজ, মাথা ঘোরা এবং মাথাব্যথা হয়।

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন 
১. তীব্র মাথাব্যথা হলে।
২. মাথার ব্যথা ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হলে।
৩. ১ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দৃষ্টিসীমায় আঁকাবাঁকা আলোর রেখা বা আলোর ঝলকানি দেখা গেলে।
৪. মাথাব্যথার পাশাপাশি কথা বলার সময় জড়তা, জ্বর ও খিঁচুনি দেখা দিলে।
৫. মুখ ও শরীরের যেকোনো দিক অবশ হয়ে গেলে।
৬. গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান জন্মদানের পরপর মাথাব্যথা দেখা দিলে।

চিকিৎসা 
মাইগ্রেন একটি জটিল সমস্যা। মাইগ্রেনের চিকিৎসায় জীবনযাত্রায় পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:
১. অ্যালকোহল ও মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাবার পরিহার করা।
২. ব্যক্তিবিশেষে যেসব খাবারে মাইগ্রেনের প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি হয় সেগুলো এড়িয়ে চলা।
৩. সূর্যের আলোর প্রতিফলন এবং গাড়ির কাঁচের প্রতিফলন বা গ্লেয়ার থেকে রক্ষা পেতে বাইরে বেরুলে ছাতা এবং পোলারাইজড সানগ্লাস ব্যবহার করা।
৪. পানিশূন্যতারোধে বেশি বেশি পানি এবং নির্দিষ্ট নিয়মে রুটিনমাফিক খাবার খাওয়া।
৫. তীব্র আলো ও কোলাহল এড়িয়ে চলা।
৬.  স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী জন্মবিরতিকরণ বড়ি গ্রহণের পরিবর্তে জন্ম নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করা।
৭. দুশ্চিন্তা ও মানসিক অবসাদ দূর করতে ব্যায়াম এবং ইয়োগা করা।

 

লেখক: 

ডা. নুসরাত সুলতানা শিমু

চিকিৎসক, সেইফওয়ে আই অ্যান্ড ডেন্টাল হাসপাতাল, মুগদা, ঢাকা

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.