শীতের হাওয়া, প্রকৃতির রুক্ষতা ও শুষ্কতা ছাপ ফেলে শরীরেও। তাই এসময় শরীর-স্বাস্থ্য, ত্বক সবকিছুরই প্রয়োজন বাড়তি যত্নের।

* ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার যেমন লেবু, কমলালেবু, পেয়ারা, মালটা প্রতিদিন খাবারের তালিকায় রাখার চেষ্টা করুন। উজ্জ্বল বর্ণের ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল বা টক ফলগুলো থেকে ফ্ল্যাভোনয়েড এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। এগুলো ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়াতে এবং খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এসব ফল শীতকালে দেহের উষ্ণতা বাড়াতেও সাহায্য করে এবং ত্বক রাখে সুরক্ষিত।

* বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে তুলনামূলক কম পরিমাণ পানি খাওয়া হয়। এটি একেবারেই ঠিক নয়। শীতের শুরু ও শেষের সময়ে ডিহাইড্রেশনের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় পানি পানের প্রবণতা কমে যায়। এসময় বেশি করে পানি পান প্রয়োজন। নরমাল পানি খেতে যাদের সমস্যা, তারা একটু উষ্ণ পানি খেতে পারেন। ব্রেকফাস্ট ও দুপুরের খাবারের মাঝে অর্থাৎ মধ্য সকালে স্যুপ, গরম দুধ, ফলের রস, মাঝে মধ্যে ডাবের পানি খেতে পারেন। এতে পানিশূন্যতা থাকবে না।

* শীতের সময়টায় বিভিন্ন ধরনের শাক পাওয়া যায়। বেছে নিতে পারেন বুটের শাক, ছোলার শাক, মোটর শাক, খেসারি শাক, পালংশাক, কলাইয়ের শাক, বতুয়া শাক যা ভিটামিন, মিনারেলস, আঁশ সমৃদ্ধ।

* শীতে শরীরে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। সবজিতে থাকে আঁশ ও প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান। তাই মৌসুমি সবজি যেমন ফুলকপি, মটরশুঁটি, শিম, মুলা, শালগম, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পেঁপে, মরিচ, নানা ধরনের বীজ, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, লাউ, গাজর আর ফলের মধ্যে আপেল, আঙুর, ডালিম, নাশপাতি, কমলা, আমড়া, বরই ইত্যাদি রাখুন রোজকার খাবারের তালিকায়। টাটকা ফল ও সবজিতে আছে বায়োটিন, যা ত্বক ও চুল ভালো রাখে।

* দুধ ছাড়া তিন-চার ফোঁটা লেবুর রস দিয়ে চা খেতে পারেন। এটি আপনার শরীরে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের কাজ করবে।

* শীতে ত্বক হয়ে পড়ে রুক্ষ। কাঠবাদামকে সাধারণত শুকনো ফলের রাজা বলা হয়ে থাকে যা ফ্যাটি এসিড, প্রোটিন এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ। শীতকালের খাবার তালিকায় এ খাবারটি থাকলে তা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত ভালো কাজ করে; কারণ এটি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। বাদাম ও সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড আছে। তাই এগুলো বেশি করে খান।

* শীতের সময় দাওয়াত খাবার ধুম লেগেই থাকে। ফলে ক্যালোরিও বেশি যায় শরীরে। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার কম খান। ভাতের পরিমাণ কম রেখে লাল আটার রুটি, চিড়া, মুড়ি, কর্ণফ্লেক্স ইত্যাদি খেতে পারেন। পাশাপাশি ফল, শাক ও ডাল বেশি খান।

* অতিরিক্ত ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন। বেক্ড স্টিম্ড খাবার খান। অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন। এতে হার্ট ভালো থাকবে।

* শীতকালে খাবার খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়। তাই খুব বেশি মশলাদার খাবার খাওয়া হয়। যার জন্য ওজন বেড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। শীতকালে খুব একটা ব্যায়াম করা হয় না। তার জন্যও অনেক সময় ওজন বেড়ে যায়। তাই হজম হয়ে গেলেও স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে খাওয়া-দাওয়া করাটাই ভালো।

* শীতকালে ঘুম খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। এছাড়া বেশিক্ষণ ধরে ঘুমানোর একটা প্রবণতাও দেখতে পাওয়া যায়। যত ঘুমানোই হোক না কেন দুপুরের দিকে একটু ঝিমুনি চলে আসে সবারই। তাই অনেক সময় শীতকালেই ঘুমানো এবং ঘুম থেকে ওঠার সময়ের কোনো ঠিক থাকে না। এতেও ওজন বেড়ে যেতে পারে। তাই যত খারাপই লাগুক না কেন একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ঘুমাতে যান এবং ঘুম থেকে উঠুন।

শীতকালীন সবজি কীভাবে খাবেন

* ময়লা, পোকামাকড় ও কীটনাশক বা রাসায়নিকের হাত থেকে বাঁচতে প্রচুর পরিমাণে পানি দিয়ে ভালো করে ধুতে হবে সবজি। একটু লবণ পানিতে ১৫ থেকে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে আরও ভালো; বিশেষ করে যদি কাঁচা খেতে চান।

* খুব বেশি সেদ্ধ করলে ভিটামিন ‘সি’ নষ্ট হয়ে যায়। তাই হালকা বা ভাপে সেদ্ধ করে খাওয়াই ভালো।

* ভিটামিন ‘এ’ তেল বা ফ্যাটে দ্রবণীয়। তাই এসব সবজি রান্না করার সময় খানিকটা তেল ব্যবহার করতে হবে। বিশেষত, যদি শিশুদের খাওয়াতে চান।

* মুখ বন্ধ প্লাস্টিকের ব্যাগে ৫/৭ দিন পর্যন্ত রেফ্রিজারেটরে রেখে খেতে পারেন। তবে শীতকালীন সবজি তাজা অবস্থায় খাওয়াই উপকারী।

ওজন কমানোর উপযুক্ত সময় শীতকাল

দেহের ওজন দ্রুত কমাতে শীতকালীন খাবার কার্যকরী। এমনকি উচ্চরক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমাতেও বিশেষ সহায়ক। এ মৌসুমে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সুষম ও খুব কম ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে অনায়াসে ওজন কমানো সম্ভব। শীতের টাটকা সবজি এবং ফলমূল আহারে আপনার একঘেয়েমি যেমন দূর হবে তেমনি সমানতালে চলবে ডায়েট। এ সময়ে বাজারে হাতের নাগালেই পাওয়া যায় নানা ধরনের ভেষজ প্রোটিন, কম ক্যালরি ও অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ শাকসবজি। যার ফলে শীতে ডায়েট কন্ট্রোল করা আরও বেশি সহজ হয়ে পড়ে।

শীতকালীন শাকসবজি শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। প্রায় সব ধরনের শাকসবজিতেই থাকে আঁশ ও প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান, যা ত্বকের বার্ধক্যরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে, আমাদের ত্বকের সজীবতা ধরে রাখে।

শীত যেমন মজার সব খাবার নিয়ে আসে, তেমনি এনে দেয় ওজন কমানোর মতো কিছু খাদ্য উপাদানও। এসব খাদ্য উপাদানে থাকে শর্করা, আমিষ, ভিটামিন এবং প্রচুর পরিমাণ পানীয়। আবার কিছু সবজি আছে যা আপনি অনায়াসেই ভাতের বিকল্প হিসেবে খেতে পারেন। ফলে আপনার ডায়েট তো হচ্ছেই পাশাপাশি আপনার ক্যালরির ঘাটতিও পূরণ হচ্ছে। তবে আপনার শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী কোন খাবার কতটুকু খাবেন সে বিষয়টি একজন পুষ্টিবিদের কাছ থেকে নির্ধারণ করে নেবেন।

টমেটো : টমেটো একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। শীতকালীন এ সবজিটি যেমন কাঁচা খাওয়া যায়, ঠিক একইভাবে রান্না করে খাওয়া যায়। শরীরকে সুস্থ-সবল রাখতে টমেটোর ভূমিকা অতুলনীয়। টমেটোতে রয়েছে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-কে, ফলিক এসিড লাইকোপিন, ক্রোমিয়াম ও আরও গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন। টমেটো লাইকোপেনের উৎকৃষ্ট উৎস। লাইকোপেন হচ্ছে একটি ক্যারোটিনয়েড পিগমেন্ট যা লাল ফলে পাওয়া যায়। এটা অত্যন্ত নিু ক্যালরিযুক্ত। ছোট একটি টমেটোতে ১৬ ক্যালরি থাকে। এটা উচ্চ দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় দুই রকম আঁশসমৃদ্ধ যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।

ফুলকপি ও ব্রকলি : প্রচুর পরিমাণে ফাইবার আর বিভিন্ন খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনের পাশাপাশি ব্রকলি ও ফুলকপিতে রয়েছে ফটো কেমিকেল যা চর্বি জমতে দেয় না শরীরে। ফুলকপি ওজন কমাতে সাহায্য করে। কেননা লো ক্যালোরি খাবার হওয়ার পাশাপাশি এতে ফাইবারও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। তাই পেট অনেকক্ষণ ভর্তি থাকে। তাছাড়াও এতে ইন্ডোল, গ্লুকোসাইনোলেট এবং থায়োসাইনেট রয়েছে যা শরীর থেকে টক্সিন বের করতেও সাহায্য করে। এক কাপ (২৪০ গ্রাম) কাটা ফুলকপিতে আছে ২৭ ক্যালরি শক্তি, ২ গ্রাম প্রোটিন।

বাঁধাকপি : বাঁধাকপি বা পাতাকপি শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি একটি পাতা জাতীয় সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যআঁশ রয়েছে। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি বাঁধাকপির রয়েছে নানা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও। সালাদে শসা, গাজর, টমেটোর সঙ্গে কচি বাঁধাকপি মেশালে তার স্বাদ হয় অত্যন্ত চমৎকার। যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। যারা ওজন কমাতে চান তারা তাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় বাঁধাকপি রাখুন।

পালং শাক : পালং শাক শীতকালীন শাকসবজির মধ্যে অন্যতম। এক কাপ পালং শাক খাদ্য আঁশের দৈনিক চাহিদার ২০% পূরণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভিটামিন এ ও কে-এর দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।

শসা : শসায় রয়েছে ডিটক্সিফিকেশন গুণ। শসায় ফাইবার আর পানির পরিমাণ বেশি থাকায় বারে বারে খুদা লাগার প্রবণতা কমায় এই সবজিটি। দুপুরের খাবারে প্রতিদিন শসা রাখতেই পারেন। এটি ওজন কমাতে টনিকের মতো কাজ করে। শসায় উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও সিলিকন আছে, যা ত্বকের পরিচর্যায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। শসায় উচ্চমাত্রায় পানি ও নিুমাত্রার ক্যালরিযুক্ত উপাদান রয়েছে। যারা দেহের ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য শসা একটি আদর্শ খাবার।

গাজর : শীতকালিন সবজির মধ্যে অন্যতম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি হল গাজর। আমাদের দেহকে সুস্থ-সবল রাখতে যেসব ভিটামিন ও খনিজ উপাদান প্রয়োজন তার সবই আছে গাজরে। গাজরে রয়েছে থায়ামিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি৬, ফলেইট এবং ম্যাংগানিজ যা স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। এছাড়াও আরও আছে ফাইবার, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে ও পটাশিয়াম। গাজরের মধ্যে থাকা ফাইবার আর নিউট্রিয়েন্ট মেদ ঝরাতে সাহায্য করে। তাই আপনার খাবার ম্যানুতে প্রতিদিন সালাদ বা সবজি হিসেবে গাজর রাখুন ।

শালগম : শালগম শীতের আর একটি পরিচিত সবজি। শালগমে রয়েছে ভিটামিন এ, সি এবং ভিটামিন কে। এতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে অথচ ক্যালরির পরিমাণ থাকে খুবই কম। ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে কোলেস্টেরলে সমস্যা জড়িত। যাদের কোলেস্টেরলের সমস্যা আছে তারা শালগম খেয়ে উপকৃত হতে পারেন। এর কারণ শালগম পাকস্থলীতে অনেক বেশি পিত্তরস শোষণ করতে পারে যা শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এভাবেই কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে শালগম।

অতিরিক্ত ওজন হ্রাস করা একটি জটিল বিষয়। আপাত দৃষ্টিতে এটি খুব সহজকাজ মনে হলেও এর জন্য প্রয়োজন অসীম ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস। খাদ্যাভাস পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রতিদিন করতে হবে ব্যায়ামও। সেইসঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুম, আর প্রচুর পানি পান করুন। মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন একই সঙ্গে। স্থায়ীভাবে ওজন হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ আদর্শ খাদ্যাভাস ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রাই সর্বোত্তম পন্থা।

 

সাজেদা কাশেম জ্যোতি
পুষ্টিবিদ

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.