বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যান বলছে, ১০-৫০ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে কোনো না কোনো সময় ব্যথা হয়েছে এবং তারা ব্যথার ওষুধ খেয়েছেন। এসব ব্যথানাশক ওষুধের মধ্যে রয়েছে, প্যারাসিটামল, অ্যাসপিরিন, ডাইক্লোফেনাক, আইবুপ্রুফেন, ইনডোমেথাসিন, ইটরিকক্রিব, নেপ্রোসিন ইত্যাদি।
ডাইক্লোফেনাক, আইবুপ্রুফেন ইত্যাদি ওষুধসেবনে ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস নামক কিডনি রোগ হতে পারে এবং আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে (AKI)। দীর্ঘদিন সেবনের ফলে ক্রনিক কিডনি ডিজিজও (CKD) দেখা দিতে পারে।
উপসর্গ
বার বার প্রস্রাব হওয়া, বিশেষ করে রাতে
ক্ষুধামান্দ
বুক ধড়ফড় করা ইত্যাদি
রোগ নির্ণয়
ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার ইতিহাস
প্রস্রাব পরীক্ষা করলে শ্বেত ও লোহিত কণিকা এবং স্বল্পমাত্রায় অ্যালবুমিন পাওয়া যায়
কিডনির আল্ট্রাসনোগ্রাফি, রক্তে ক্রিয়াটিনিন পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যায়
চিকিৎসা ও প্রতিকার
সন্দেহজনক ওষুধ বন্ধ করা
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া
হার্বাল মেডিসিন (ভেষজ ওষুধ) ও কিডনি রোগ
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ লোক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার জন্য ভেষজ ওষুধ (হার্বাল মেডিসিন) ব্যবহার করে থাকেন। কোনো কোনো দেশে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ এসব ওষুধসেবন করেন। যেহেতু কিডনির মাধ্যমে বেশির ভাগ ওষুধ শরীর থেকে নিঃসৃত হয়, সেহেতু কিডনির ওপর এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়।
বিশ্বে চাইনিজ হার্বাল মেডিসিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান এরিস্টোলকিক এসিড নামক উপাদান ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস, কিডনি ক্যানসার ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজের কারণ হতে পারে। আমাদের দেশে কিছু কিছু বনজ ওষুধে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি হেভি মেটাল থাকতে পারে, যা বহুদিন ব্যবহারের ফলে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে।
কিডনির সিস্ট
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষায় কিডনিতে সিস্টের অস্তিত্ব দেখে রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিডনিতে সিস্ট হওয়া মানে হচ্ছে, কিডনির টিস্যুর মধ্যে জায়গায় জায়গায় পানির মতো জমা হয়। এই ধরনের সিস্টের মধ্যে কিছু সিস্ট আছে, যেগুলোকে ‘simple cyst’ বলা হয়। সেগুলো নির্দোষ। এই সিস্ট অনেক বড় হলে ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ‘ড্রেইন’ করতে হয়। কিছু কিছু সিস্ট আছে যেগুলো বংশগত। বংশগত সিস্ট উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ফেইলিওর বা ক্যানসারের কারণ হতে পারে। এই সব সিস্ট নিয়মিত নজরদারিতে রাখতে হয়।
কিডনির ক্যানসার
মানবদেহে অন্য যে কোনো অঙ্গের মতো কিডনিরও ক্যানসার হতে পারে। মানুষের শরীরে যত ক্যানসার হয়, তার মধ্যে শতকরা ৩ ভাগ কিডনির ক্যানসার এবং এটা পুরুষদের বেশি হয়।
কী কারণে কিডনির ক্যানসার হয়
ধূমপান
বেশি ভাজাপোড়া ও মাংস খাওয়া
ফেনাসিটিন জাতীয় ওষুধসেবন
ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেস্টস এক্সপোজার
উপসর্গ
মেরুদণ্ডের পাশে পাঁজরের নিচে ব্যথা হতে পারে। প্রস্রাবে রক্ত কণা যেতে পারে।
রোগ নির্ণয়
কিডনির আলট্রাসনোগ্রাফি
কিডনির সিটি স্ক্যান
চিকিৎসা
প্রাথমিক অবস্থায় হলে সার্জিক্যাল চিকিৎসা খুবই ফলপ্রসূ হয়।
মূত্রথলির ক্যানসার
মূত্রথলিতেও ক্যানসার হতে পারে। সাধারণত ধূমপান, ফেনাসিটিন, সাইক্লোফেসফামাইড জাতীয় ওষুধসেবন, স্যাকারিন জাতীয় মিষ্টি, রেডিও থেরাপি (নিচ পেটে) নেওয়া ফলে এ সমস্যা দেখা দেয়।
রোগ নির্ণয়
প্রস্রাব পরীক্ষা
আলট্রাসনোগ্রাফি
সিটি স্ক্যান
চিকিৎসা
সার্জিক্যাল/মেডিকেল
আকস্মিক কিডনি বিকল রোগ (AKI)
আকস্মিকভাবে যদি কিডনি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি রক্তের ক্রিয়াটিনিন বেড়ে যায় এবং প্রস্রাবের পরিমাণ দ্রুত কমে যায়; তখন এই অবস্থাকে আকস্মিক কিডনি বিকল রোগ বলা হয়।
ইনজুরি একেআই’র কারণ
ডায়রিয়া বা বমির কারণে শরীরে তীব্র পানিশূন্যতা হলে
প্রসবকালীন জটিলতার কারণে
অপারেশন পরবর্তী জটিলতা
রক্তক্ষরণ বেশি হলে
ভূমিকম্প বা সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে শরীরে ভয়ানক আঘাত পেলে
ব্যথানাশক ওষুধসেবনে
অগ্নিদগ্ধ হলে
পানিতে ডুবে গেলে
নেফ্রাইটিস রোগ
বোলতা বা সাপের কামড়
ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি
রোগ নির্ণয়
রোগীর ইতিহাস
হঠাৎ করে প্রস্রাব কমে যাওয়া
রক্তে ইউরিয়া, ক্রিয়াটিনিন বেড়ে যাওয়া
উল্লেখ্য, আকস্মিক কিডনি বিকল রোগ প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে কিডনি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া না গেলে রোগী মারা যেতে পারে। বেঁচে থাকলে পরবর্তীকালে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে।
কিডনি চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ নেফ্রোলোজি আকস্মিক কিডনি বিকল রোগের কারণে মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যার নাম হচ্ছে, ‘o by 25’. এ কর্মসূচির মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে আকস্মিক বিকলজনিত মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশও এ কর্মসূচির সাথে যুক্ত রয়েছে।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ
কিডনির গঠন প্রকৃতি ও ফাংশানের কোনো অস্বাভাবিকতা (GFR বা সিরাম ক্রিয়াটিনিন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়) যদি তিন মাসের বেশি সময় বজায় থাকে, তখন তাকে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) বলা হয়। ক্রনিক কিডনি ডিজিজ একটি নীরব ঘাতক। প্রাথমিকভাবে এ রোগের কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে। কিডনির ফাংশান শতকরা ৫০ ভাগের বেশি নষ্ট হলেই শুধুমাত্র রক্তের ক্রিয়াটিনিন বাড়তে শুরু করে এবং কিডনির ফাংশান শতকরা ৭০ ভাগের বেশি নষ্ট হলে উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। তবে একটি ফর্মুলার মাধ্যমে ‘CGFR’ নির্ণয় করা গেলে আগেভাগেই আঁচ করা যায় যে, ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হতে যাচ্ছে।
উপসর্গ
চোখের পাতা ও পা ফুলে যাওয়া
ক্ষুধামান্দ ও বমি বমি ভাব হওয়া
ক্রমান্বয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা
চিন্তাশক্তি কমে যাওয়া
গায়ের রং কালচে হয়ে যাওয়া
বিনা কারণে গা চুলকানো
রাতে ঘনঘন প্রস্রাব
রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
কোমরের দুই পাশে ব্যথা
প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, প্রস্রাব লাল হওয়া, প্রস্রাবে ফেনা হওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া।
রোগ নির্ণয়
রোগীর ইতিহাস
প্রস্রাব পরীক্ষা
রক্তের ইউরিয়া ও ক্রিয়াটিনিন পরীক্ষা
কিডনির আল্ট্রাসনোগ্রাফি
চিকিৎসা ও প্রতিকার
কারণ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে নেফ্রাইটিস রোগের চিকিৎসা সম্ভব। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রক্তে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ইউরিক এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডায়ালাইসিস করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন হলে কিডনি সংযোজন (Transplantation) করতে হবে।
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ও রক্তশূন্যতা
ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীরা শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে রক্তশূন্যতায় ভুগে থাকেন। পুরুষদের হিমোগ্লোবিন শতকরা ১৩ গ্রাম ও নারীদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিন ১২ গ্রামের নিচে হলে রক্তশূন্যতা হিসেবে গণ্য করা হয় ।
কারণ
ইরাইথ্রোপয়োটিন নামক হরমোনের স্বল্পতা
ডায়ালাইসিস সংশ্লিষ্ট কারণে রক্তক্ষরণ আয়রন ও ফলিক এসিডের অভাব
পুষ্টিজনিত
লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া
উপসর্গ
খাদ্যে অরুচি
বুক ধড়ফড় করা
অল্প পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট হওয়া
রোগ নির্ণয়
রক্তের হিমোগ্লোবিন ও ব্লাড ফিল্ম পরীক্ষা
চিকিৎসা
রক্তের আয়রন ও ফলিক এসিডের ঘাটতি পূরণ ইরাথ্রোপয়োটিন হরমোন ইনজেকশন হিসেবে নেওয়া
রক্ত সঞ্চালন
কখন ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন করতে হবে
যখন কিডনির ফাংশান ১৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে তখন ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজনের প্রস্তুতি নিতে হয়।
কিডনি ফাংশান ১০ শতাংশের কম হলে ডায়ালাইসিস শুরু করতে হয় বা কিডনি সংযোজন করতে হয়। প্রয়োজনে আগ বাড়িয়ে ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন করা যায়।
ডায়ালাইসিস কি
এটি একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কিডনি অকেজো রোগীর রক্তের জমে যাওয়া দূষিত পদার্থ মেশিনের মাধ্যমে বের করা হয়। এছাড়া পেটের ভেতরের ‘পেরিটোনিয়াম’ নামক পর্দার মাধ্যমেও ডায়ালাইসিস করা যায়।
ডায়ালাইসিস কত প্রকার
ডায়ালাইসিস দুই প্রকার। হিমো ডায়ালাইসিস ও পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস
হিমো ডায়ালাইসিস কি
এ পদ্ধতিতে ডায়ালাইসিস মেশিনের সাহায্যে ডায়ালাইজার নামক ফিল্টার ব্যবহার করে রক্তের দূষিত পদার্থ ডায়ালাইসিস ফ্লুয়িডের মাধ্যমে বের করা হয়। সাধারণত সপ্তাহে ২-৩ বার এ ডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতিবারে ৩.৫-৪ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস করা হয়। রোগী বাড়ি থেকে ডায়ালাইসিস সেন্টারে গিয়ে ডায়ালাইসিস করতে পারে। আবার মেশিন কিনে নিয়ে বাসায় বা অফিসে ডায়ালাইসিস করা যায়। ডায়ালাইসিস মেশিনের আরেক নাম আর্টিফিশিয়াল কিডনি।
ডায়ালাইসিস রোগীর খাদ্য
ডায়ালাইসিস রোগীদের পর্যাপ্ত আমিষ খেতে হয় (১-১.২ কেজি প্রতিদিন)
ফলমূল পর্যাপ্ত খাওয়া যায়।
শাকসবজি পছন্দমতো
পানীয় দৈনিক আধা থেকে এক লিটার
সাধারণভাবে ডায়ালাইসিস চলাকালীন না খাওয়া ভালো। তবে ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে রক্তের সুগার কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে হালকা খাবার খাওয়া যায়।
ডায়ালাইসিস করে কত দিন ভালো থাকা যায়
পর্যাপ্ত ডায়ালাইসিস করে ১৫-২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকা যায়। আবার ডায়ালাইসিসের বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে কিডনি সংযোজনও করা যায়। এমনকি ডায়ালাইসিস না করে সরাসরি কিডনি সংযোজন করা যায়।
হিমো ডায়ালাইসিসে কী অসুবিধা হতে পারে
মাথাব্যথা
বমির ভাব ও বমি হওয়া
বুকে ব্যথা হওয়া
ফিস্টুলার লাইনে ব্যথা হওয়া
পায়ের মাংসপেশিতে কামড়ানো
চুলকানি
নাক থেকে রক্ত পড়া
বুক ধড়ফড় করা
রক্তের চাপ কমে গিয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
ফিস্টুলা কী
সাধারণত রোগীর বাম হাতের দুটি রক্তনালী (একটি শিরা ও একটি ধমনি) জোড়া দিয়ে এক ধরনের চ্যানেল তৈরি করা হয়। এই ফিস্টুলার সাহায্যে ডায়ালাইসিস মেশিনের সাথে রোগীর রক্তনালীর সংযোগ স্থাপিত হয় এবং ডায়ালাইসিস সম্পন্ন হয়।
ফিস্টুলার যত্ন
ফিস্টুলাকে ডায়ালাইসিস রোগীর লাইফ লাইন বলা হয়। যে হাতে ফিস্টুলা থাকবে সে হাতে ভারী কোনো কাজ করা যাবে না, ওজন তোলা যাবে না, ঘড়ি বা গয়না পরা যাবে না, রক্তচাপ মাপা যাবে না, কোনো ইনজেকশান দেওয়া যাবে না এবং ওই হাত মাথার নিচে রেখে শোয়া যাবে না।
অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল আলম
প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ, সাবেক প্রোভিসি (প্রশাসন), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা