স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। যা মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্তক্ষরণ অথবা রক্তনালীতে রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে হয়ে থাকে। রক্তক্ষরণের কারণে যে স্ট্রোক হয়ে থাকে তাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক আর রক্ত সরবরাহ বন্ধের জন্য যে স্ট্রোক হয়ে থাকে তাকে ইস্কেমিক স্ট্রোক বা   রক্ত সংরোধজনিত স্ট্রোক বলা হয়। স্ট্রোককে সেরিব্রোভাস্কুলার এক্সিডেন্ট(CVA) বা সেরিব্রোভাস্কুলার ইনসাল্ট(CVI) ও বলা হয়ে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দ থেকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও পারস্য সভ্যতায় স্ট্রোক ও পারিবারিক স্ট্রোকের বর্ণনা পাওয়া যায়।

স্ট্রোকের অনেক কারণ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের প্রধান কারণ। এ ছাড়া এ্যানিউরিজম (রক্তনালী অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে যাওয়া), ধমনী ও শিরার অস্বাভাবিক সংযোগ(আর্টেরিও-ভেনাস ম্যালফরমেশন), মস্তিষ্কে আঘাত, বিভিন্ন ধরনের রক্তক্ষরণ রোগ, যকৃতের রোগ, রক্ত জমাট বাঁধতে বাধাদানকারী ঔষুধ সেবন ইত্যাদি কারণে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হতে পারে। রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকে রক্ত জমাট বেঁধে পার্শবর্তী মস্তিস্কের কোষগুলোতে চাপ সৃষ্টি করে। এতে কোষগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আর ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়ে থাকে রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, স্থূলতা, ধূমপান, বহুমূত্র রোগ, শেষ বয়সে কিডনির রোগ, হার্টের ভালভের রোগ, ক্যারোটিড ধমনীতে চর্বি জমার ফলে। এতে মস্তিষ্কের ছোট বা বড় রক্তনালী বন্ধ হয়ে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায়। এ কারণে মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এতে বিপাক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন দূষিত পদার্থ নিষ্কাশন হতে পারে না।

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য দায়ী। স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কর যে অংশ আক্রান্ত হবে, সে ধরনের উপসর্গ তৈরি হবে। তবে মাথা ব্যথা, মাথা ঘুরানো, হাঁটতে ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় অসুবিধা হওয়া, শরীরের এক পাশ বা উভয় পাশ অবশ বা দূর্বল হয়ে যাওয়া, বমি হওয়া, কথা না বুঝতে পারা বা বলতে না পারা, চোখে দেখতে সমস্যা, কানে না শোনা, প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারা ইত্যাদি উপসর্গ হয়ে থাকে। এ সকল উপসর্গ ২৪ ঘণ্টার কম সময় ধরে স্থায়ী হলে তাকে ট্রানজিয়েন্ট ইস্কেমিক অ্যাটাক বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের ত্রুটির ফলে উদ্ভূত স্নায়ুবিক ঘাটতি যা ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিদ্যমান থাকে বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে। ভুল ধারণা প্রচলিত আছে স্ট্রোক হৃদযন্ত্রেও হয়, মস্তিষ্কেও হয়, এটা ঠিক নয়। স্ট্রোক শুধুমাত্র মস্তিষ্কের রোগ।

স্ট্রোক হলে বা সন্দেহ হলে দ্রুত রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতাল ও নিউরোমেডিসিন বা নিউরোসার্জারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান বা এমআরআই পরীক্ষা করে এ রোগ নির্ণয় করা যায়। তবে স্ট্রোকের প্রকৃত কারণ নির্ণয়ের জন্য আরও অনেক পরীক্ষা করতে হয়।

হেমোরেজিক স্ট্রোকে অস্ত্রোপচার বা অপারেটিভ ট্রিটমেন্ট করতে হয়। এবং অবশ্যই রক্ত তরলীকরণের ঔষধ সেবন বন্ধ করতে হয়। ইস্কেমিক স্ট্রোকে রক্ত তরলীকরণের ঔষধ, চর্বি, শর্করা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধ, রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধির ঔষধ দেওয়া হয়। ক্যারোটিড ধমনীতে স্টেন্টিং বা এন্ডআর্টেরেক্টমিও লাগে ক্ষেত্রবিশেষে। অন্যান্য কারণে স্ট্রোক হলে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সেটা নির্ধারণ ও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা রোগীর জন্য সুফল বয়ে আনে।

সুস্থ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম ও শরীরচর্চা, মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন, ধূমপান, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সঠিক চিকিৎসা ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, কল্যাণকামী জনবান্ধব রাষ্ট্রগঠন করে স্ট্রোক নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখা যায়। স্ট্রোকের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে তাদের  আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে ঝুঁকি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রোগমুক্ত থাকা সম্ভব।

স্ট্রোক হওয়ার আগেই প্রতিরোধ বেশি ফলপ্রসূ। মননশীল সমাজ ও পরবর্তী প্রজন্ম তৈরিতে সঠিক জীবনাচরণের শিক্ষার বিকল্প নেই এবং এর দায় প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের। স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সকলের যত্ন, সচেতনতা ও সহযোগিতা।

 

লেখক:

ডা. সুমাইয়া বিনতে শওকত

কার্ডিয়াক, ভাস্কুলার এন্ড থোরাসিক সার্জন, মেট্রোপলিটান মেডিকেল সেন্টার, মহাখালী, ঢাকা।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.