জন্মের প্রথম বছরে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ; মগজের নানা বিন্যাস ও নব নব সামর্থ্য অর্জন খুব দ্রুত হয়ে থাকে। এটি এমন না, সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে তা ছন্দাবদ্ধভাবে ঘটবে বরং এসবের উত্থান ঘটে হঠাৎ, যা শিশুর আচরণে গুণগত পরিবর্তন এনে দেয়।

এ পর্যায়ে শিশুকে ঠিকমতো খাওয়ানো, তার নিদ্রাজাগরণের তদারকি করতে করতেই নতুন মা-বাবার ব্যস্ত সময় কেটে যায় এবং এতে করে শিশুর মা-বাবার মাঝে সম্পর্কের গভীরতা বিস্তার লাভ করে। সম্পর্কের এ আদি ভূমিতে ভর করেই ভবিষ্যৎ শিশুর জ্ঞান, ভাবাবেগ ও মানসিক বৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়ে থাকে।

প্রথম দু’মাসে শিশু কী রকম বাড়বে

জন্মের প্রথম সপ্তাহে নবজাতক শিশু তার জন্মকালীন ওজন প্রায় ১০ শতাংশ হারিয়ে বসে। নবজাতক শিশুকে প্রথম ও একমাত্র খাবার হিসেবে শালদুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে শুভ সূচনা করা হলে মায়ের বুকে তাড়াতাড়ি প্রচুর দুধ চলে আসে, এভাবে শিশু বুকের দুধ পান করার সফল পদ্ধতি জেনে গেলে নিজের প্রয়োজনমতো দুধ গ্রহণে সমর্থ হয়ে ওঠে। জন্মের ২ সপ্তাহের মধ্যে সে জন্মকালীন ওজন ফিরে পায়, কখনও বা তা অতিক্রম করে।

প্রথম দিকে সমান্তর নিদ্রা ও জাগরণে তার দিন কাটে। এ সময় কোনো কারণে তার দিনের ঘুমের ব্যাঘাত হলে রাতে দীর্ঘ ঘুম দিয়ে সে তা পুষিয়ে নেয়। এমনকি ২ মাস বয়সে পৌঁছেও বেশিরভাগ শিশু শুধু খাওয়ার জন্য ২ থেকে ৩ বার স্বল্প সময়ের জন্য জেগে থাকে। কেউ কেউ আবার একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ঘুমিয়ে কাটায়।

জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ

শিশুকে যত্নআত্তি করার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডগুলো তার দৃষ্টি স্পর্শ, ঘ্রাণ ও শব্দ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়শক্তির উদগমন ঘটায়। শিশুকে ঘিরে এসব উদ্দীপক কাজকর্ম শিশুর জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ বয়সের শিশুটিও কেবল নিত্যনতুন ব্যাপারের প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠে এবং প্রতিদিনকার একঘেয়ে বা একই রকমের শব্দ, বর্ণ ও ক্রিয়ার প্রতি কম উৎসাহ পোষণ করে।

শিশুকে খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম

এ পর্যায়ে এরিকসন বর্ণিত মানসিক জগতের প্রথম ধাপে শিশু অবতরণ করে; যখন সে বুঝে যায়, তার জরুরি চাহিদাগুলো যথাযথ মেটানো হচ্ছে তখনই এ পর্বটি তার মধ্যে বিকশিত হয়। এ বয়সের শিশুকে সঠিক যত্ন নেয়া গেলে, তার অসুবিধার প্রতি তাড়াতাড়ি সাড়া দেয়া গেলে সেই শিশু ১ বছর বয়সে কম কান্না করা কিংবা ২ বছর বয়সে কম উত্তেজিত থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে। খিদের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে শিশুর মধ্যে উত্তরোত্তর টেনশন বাড়ে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সে কেঁদে দেয়। তবে খিদে মেটানো হলে টেনশন লোপ পায়। শিশু যখনই খেতে চায়, যতক্ষণ খেতে চায় এ নিয়ম মেনে তার চাহিদামাফিক খাওয়ানোর এ অভ্যাসে তাকে গড়ে তোলা হলে, শিশু তার খিদে পাওয়া, মা-বাবার উপস্থিতি ও খাওয়ানো এ তিনের মাঝে আনন্দময় যোগসূত্র খুঁজে পায়। শিশুকে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাওয়ানোর নিয়মে রপ্ত করা হলেও সে তার খিদে পাওয়াটা সেভাবে মানিয়ে নেয় এবং ভালো থাকে।

যে মা-বাবা শিশুকে খাওয়াতে গিয়ে এ দুটির কোনোটিই মেনে চলেন না, হয় খিদেয় ভুগে ভুগে শিশুর প্রচুর ক্লান্তি কিংবা টেনশনের শেষে খিদে মেটান, নয় তো অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভরা পেটে আবারও খাওয়াতে চেষ্টা করেন। সে শিশুর মধ্যে গড়ে ওঠে না শারীরবৃত্তীয় কোনো সুষম প্রাকৃতিক নিয়ম।

এ ছাড়া কোনো পিতামাতা যখন নিজের সুবিধামতো শিশুকে খাওয়াতে যান, যেখানে না আছে শিশুর খিদে, আছে কিনা দেখার প্রতি সর্তক দৃষ্টি বা না থাকে শিশুকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাওয়ানোর কোনো রুটিন সেসব শিশু খাবারের পর কোনো পরিতৃপ্তি পায় না, বরং এসব শিশু পরবর্তীকালে মানসিক ভারসাম্যহীনতার প্রকাশস্বরূপ ঘন ঘন পেটের অসুখ, ওজনে ঠিকঠাক না বাড়া কিংবা আচার-আচরণের অসংলগ্নতা ইত্যাদিতে ভোগার আশঙ্কা থাকে।

 

লেখক :

অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

শিশু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.