শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র খাবার। একে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং (ইবিএফ) বলা হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ইবিএফের হার ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিশুর জন্মের প্রথম বছরে অপুষ্টির কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবছর ৬০ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। আধুনিক ব্যস্ত এই শহুরে জীবনে কর্মজীবী মায়েরা বাচ্চাকে বুকের দুধের পরিবর্তে বিভিন্ন রকম কৃত্রিম ফর্মুলা দুধ খাওয়ান। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃত্রিম এসব ফর্মুলা দুধ কি স্বাস্থ্যসম্মত এবং বাচ্চার জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়?

প্রথম ছয় মাস বুকের দুধ খেলে শিশু সুস্থ থাকবে

১. ফর্মুলা দুধ ১০০ শতাংশ জীবাণুমুক্ত থাকে না। এতে শিজেলা, সালমনেলা এমনকি ক্রনোব্যাকটারের মতো জীবাণু থাকতে পারে, যা সেপসিস, মেনিনজাইটিস ও নেক্রোটাইজিং এন্টারোকোলাইটিস নামক মারাত্মক রোগের কারণ।

২. ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হলে শিশুদের প্রাকৃতিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় না। ফলে জন্মের প্রথম বছরেই বিভিন্ন প্রকার জীবাণুর সংক্রমণ, যেমন নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু চার মাসের বেশি বুকের দুধ খায়, তাদের চাইতে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের ৩ দশমিক ৬ গুণ বেশি আরএসভি ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়া, ২ দশমিক ৮ গুণ বেশি কলেরা, ই কোলাই ও রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়া এবং ২ দশমিক ৪ গুণ নেক্রোটাইজিং এন্টেরোকলাইটিস নামক মারাত্মক চর্মরোগ হয়ে থাকে।

৩. গবেষণায় আরও দেখা যায়, ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো বাচ্চারা ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি শৈশবকালীন স্থূলতা, ১ দশমিক ৬ গুণ বেশি টাইপ ১ ও ২ ডায়াবেটিস, ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি অস্থিমজ্জার ক্যানসার, ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি অ্যাজমা ও ১ দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ১ গুণ বেশি আকস্মিক শিশুমৃত্যুর সিনড্রোম নামক রোগে আক্রান্ত হয়। প্রথম বছরে ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি শিশুমৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।

৪. যেসব শিশু ৩ মাসের বেশি বুকের দুধ খায়, তাদের চাইতে ফর্মুলা দুধ খাওয়া বাচ্চাদের মধ্যকর্ণের সংক্রমণ দ্বিগুণ বেশি হয়ে থাকে। দাঁত ও হাড় ঠিকমতো মজবুত হয় না এবং দাঁতের আশপাশে গর্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শিশুর অ্যালার্জি, গ্যাস্ট্রিক, পেটব্যথা ও হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৫. ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো বাচ্চাদের মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা, যেমন বুদ্ধিমত্তা মধ্যম মাত্রায় কম থাকে এবং এসব শিশুদের হামাগুড়ি দেওয়া ও হাঁটার মতো শারীরিক যোগ্যতাগুলো কিছুটা দেরিতে অর্জিত হয়।

৬. বুকের দুধ না খাওয়ানো মায়েদের স্তন ক্যানসার, জরায়ু ক্যানসার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও বিপাকীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়।

বুকের দুধ খাওয়ালে শিশু যেমন আরাম পাবে, মাও থাকবেন স্বস্তিতে

এসব বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো জন্মের পর ছয় মাসের জন্য সমানে বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশ মাতৃদুগ্ধ বিকল্প ও শিশু খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা তা ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিপণন, বিজ্ঞাপন মুদ্রণ, প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশ করলে অথবা শিশু অসুস্থ বা মৃত্যু হলে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

ফর্মুলা দুধ কখনোই মায়ের বুকের দুধের সমকক্ষ নয়। এ জন্য মাতৃসদন হাসপাতালে প্রসূতি ডাক্তারদের গর্ভকালীন সাক্ষাতে এবং জন্মের পর বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য মাকে জোরালো পরামর্শ দিতে হবে। জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি বাড়াতে হবে। ফর্মুলা দুধ বাচ্চাকে ওই সময় খাওয়ানো যেতে পারে, যখন বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ পায় না অথবা বাচ্চার মা মারা যান। গরুর দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত ফর্মুলা দুধ না খাওয়ানো উচিত। শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর আগে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে ভালোভাবে পরামর্শ করে নেবেন।

 

ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন

এমডি গবেষক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published.