মাংস উচ্চ জৈব মূল্যবিশিষ্ট প্রাণিজ আমিষ। যা উদ্ভিজ্জ আমিষের তুলনায় অনেক উন্নতমানের। কারণ এতে সব প্রয়োজনীয় এসিড বিদ্যমান। এছাড়া আছে লৌহ, ফসফরাস, ভিটামিন বি১ ও ভিটামিন বি২।
সব বয়সের লোকেরই আমিষ প্রয়োজন কোষের ক্ষয়পূরণের জন্য। এ ছাড়া পর্যাপ্ত জিঙ্ক থাকার কারণে দেহের ক্ষত, পোড়া ঘা সারানোর জন্য লাল মাংসের প্রয়োজন রয়েছে।
খেলোয়াড়দের দেহ থেকে ঘামের সঙ্গে জিঙ্কও বেরিয়ে যায়। সে জন্য তাদের খাবারে মাংস রাখা যেতে পারে। দেখা যায় নিরামিষ ভোজীদের দেহে জিঙ্কের অভাব হয়ে থাকে। পেশিশক্তি বাড়াতেও মাংসের জুড়ি নেই।
শিশু, গর্ভবতী নারী ও স্তন্য দানকারী মায়েদের আমিষ প্রয়োজন অন্যদের চেয়ে বেশি। নিম্নবিত্তদের প্রোটিনের ঘাটতি সবসময় থাকে। যদি তাদের সদিচ্ছা থাকে, তাহলে কোরবানির সময় তারা সেই ঘাটতি অনেকখানি মিটাতে পারে। মাংসের চর্বি শুধু স্নেহ পদার্থের অভাবই পূরণ করে না। এটি ভিটামিনও সরবরাহ করে থাকে।
এদিকে মাংসে অবস্থানকারী রোগ জীবাণু দেহে বিষ উৎপাদন করে। এ জন্য রোগাক্রান্ত পশুর মাংস খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই যারা ঈদের সময় কোরবানি দেবেন তারা এই বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।
স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রান্না
মাংস কোটা, ধোয়া, রাখা সবই হতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে। যে টেবিলে অথবা যে স্থানে এবং যে ছুরি বা বঁটি দিয়ে মাংস টুকরা করবেন সবই যেন পরিষ্কার থাকে। অস্বাস্থ্যকর অপরিষ্কারভাবে রান্না করা মাংস থেকে পেটে ব্যথা, খিঁচুনি, মাথাব্যথা, পেট খারাপ ও জ্বর হতে পারে। বেশি তাপে মাংস রান্না করলে প্রোটিন সংকুচিত হয়ে শক্ত হয়ে যায়। ফলে হজমে সমস্যা হয়। রান্নার সময় স্বাভাবিক সুন্দর ঘ্রাণটি আসে এর নির্যাস ও ধাতব লবণের জন্য।
রান্নার সময় কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে
* মাংস ঢেকে রান্না করতে হবে। এতে এর পুষ্টিমান ও স্বাদ বজায় থাকবে।
* ঈদের মাংসে চর্বি বেশি থাকে বলে যতটা সম্ভব চর্বি ছাড়িয়ে রান্না করতে হবে।
* রান্নায় কম তেল ব্যবহার করা ভালো।
* মাংসের ঝোলের মধ্যে বি-ভিটামিন দ্রবীভূত থাকে বলে বেশি পানি দিয়ে রান্না করা ভালো। তবে কখনই সিদ্ধ করে পানি ফেলে দেয়া উচিত নয়। এতে পুষ্টির অপচয় হয়।
* কম তাপে অল্প মসলা সহযোগে মাংস রান্না করলে এর গুণাগুণ বজায় থাকে। কারণ উচ্চতাপে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মাংস রান্না করলে এতে পলিসাইক্লিক হাইড্রোকার্বন ও হেটেরোস সাইক্রিক অ্যামাইন জাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপন্ন হয়।
* যাদের হৃদরোগ ও কোলস্টেরল বেশি তারা মগজ, কলিজা, হাড়ের স্টু বা নেহারি এড়িয়ে চলুন।
* মাংস ঝলসিয়ে অথবা শামী কাবাব তৈরি করে খেলে চর্বি অনেকখানি কমানো সম্ভব। আবার মাংসের কিমা করে বিভিন্নভাবে রান্না করে খাওয়া যেতে পারে।
* মাংসের প্রোটিন জমাট বাঁধে ১৭০০ ফারেন হাইট বা ৭৭০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়।
* মাংসের টুকরা বড় করলে এর খাদ্যমূল্যের অপচয় কম হয়। তাপে থায়ামিন নষ্ট হয় ৩০ শতাংশ এবং রাইবোফ্লাভিন নষ্ট হয় ২০ শতাংশ।
মাংসের চর্বি কমানোর উপায়
* মাংস হলুদ ও লবণ মেখে সিদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দিন। ওপরে চর্বি জমাট বাঁধলে সেই চর্বি ফেলে দিন।
* কাঁচা মাংস একটি ঝাঁঝরিতে নিয়ে ফুটন্ত পানির পাত্রের মুখে বসিয়ে রাখুন। চর্বি গলে নিচের পাত্রে পড়বে। তারপর স্বাভাবিক নিয়মে রান্না করুন।
* আগুনে ঝলসে রান্না করলে অথবা শিক কাবাব করে খেলে চর্বি অনেকখানি কমে।
* যদি মনে হয় মাংসে তেল বেশি হয়েছে, তাহলে ঝোল বাদ দিয়ে মাংস খাওয়া ভালো।
মাংস সংরক্ষণ
সংরক্ষণের অজ্ঞতার জন্যও অনেক সময় খাবারটি দূষিত হয়ে পড়ে। মাংস কোটা, ধোঁয়া, প্যাকেট করা, ঠাণ্ডা করা, রান্না ইত্যাদিতে সতর্কতা প্রয়োজন। কাঁচা মাংসে সহজেই ব্যাকটেরিয়া বিস্তার লাভ করে। টিনিয়া সেলেনিয়াম নামক প্যারাসাইট লাল মাংসে থাকে। এটা দেহে বিশেষ এক ধরনের যক্ষ্মার জন্ম দেয়। এ জাতীয় জীবাণু অন্ত্র, পাকস্থলী, যকৃত প্রভৃতি জায়গায় প্রবেশ করে আমাদের অসুস্থ করে তোলে। অর্ধসিদ্ধ মাংস খেলে এ ধরনের রোগের বিস্তার ঘটে। সংরক্ষণের সময় মনে রাখতে হবে যাতে এর স্বাভাবিক স্বাদ ও গন্ধ বজায় থাকে।
কাঁচা মাংসের স্বাভাবিক পানি ফেলে যত দ্রুত সম্ভব প্যাকেট করে ডিপ ফ্রিজে রাখা উচিত। এই ক্ষেত্রে নতুন প্যাকেট ব্যবহার করা ভালো। এতে বেশি দিন ভালো থাকে। ডিপ ফ্রিজে ১৮০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে অন্তত পক্ষে পাঁচ-ছয় মাস পর্যন্ত রাখা যায়।
রান্না করা মাংস সংরক্ষণের ইচ্ছা থাকলে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা করে ফ্রিজে রেখে দেয়াই উত্তম। যদি রান্না করা মাংস ফ্রিজের বাইরে রাখতে হয় তাহলে প্রথম দু’দিন দিনে দুইবার জ্বাল দিতে হবে। এরপর দিনে একবার জ্বাল দিলেই চলবে। এমনভাবে জ্বাল দিতে হবে যাতে মাংসের সম্পূর্ণ অংশে তাপ পৌঁছে যায়। তারপর ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত ঢাকনা দেয়া যাবে না। গ্রামাঞ্চলে এখনও দেখা যায় মাংস ধুয়ে লবণ ও হলুদ মেখে রোদে শুকিয়ে বা আগুনের তাপে শুকিয়ে রাখা হয়। অনেকটা মাছের শুঁটকির মতো। কাঁচা হোক বা রান্না হোক সংরক্ষণের সময় পানি শুকিয়ে রাখলে বেশিদিন ভালো থাকবে। কিডনিতে পাথর হলে মাংস একেবারে বাদ দেয়া উচিত। এ ছাড়া বাতের সমস্যা থাকলে মগজ, গুর্দা, কলিজা সংরক্ষিত মাংস, স্যুপ বাদ দেয়া ভালো। কিডনির রোগ, উচ্চরক্তচাপ, যকৃতের রোগ, হৃদরোগের ক্ষেত্রে মাংস যত কম খাওয়া যায়, তত ভালো। অগ্ন্যাশয়ের রোগে প্রাণিজ চর্বি বাদ দেয়া ভালো।
টকদই, অলিভওয়েল, লেবুর রস, রসুন বাটা, তেঁতুলের পানি, পেঁপে বাটা ইত্যাদি দিয়ে মাংস ম্যারিনেট করে রাখলে মাংসের ক্ষতিকর চর্বি কমানো যায়।
যত পুষ্টিকর হোক না কেন, ঈদের সময় মাত্রাতিরিক্ত মাংস খেলে হজমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। ফলে মাথাব্যথা, বমি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য প্রতিদিনই মাংস খাওয়া যাবে তবে মাত্রাজ্ঞান রেখে।
লেখক :
আখাতরুন নাহার আলো
চিফ নিউট্রিশন অফিসার (অব.), বারডেম হাসপাতাল, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শ্যামলী, ঢাকা