গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। আমাদের দেশের যদিও পরিসংখ্যান সম্পূর্ণভাবে নেই। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় পরিসংখ্যান করা হয়েছিল। দেখা গেল যে, ১৩.৫% মহিলারা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ে ভুগছেন।
ডায়াবেটিস এবং প্রেগনেন্সি অথবা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দুটো দু রকম হতে পারে।
একটা হলো যে রোগীর আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে। আরেকটা হলো যে, রোগী গর্ভাবস্থায় আসার পরে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। সেখানে কিছু কিছু ঝুঁকি থাকে। যেমন তার বংশগত ইতিহাস থাকতে পারে, পারিবারিকভাবে আগে থেকেই ডায়াবেটিস থাকতে পারে। তার হয়তো কয়েকটি গর্ভপাত হয়েছে এর আগে। অনেক বড় বাচ্চা ডেলিভারী করতে গিয়ে হয়তো মারা গেছে। বারবার গর্ভপাত হয়। এছাড়াও তার উচ্চরক্তচাপ, প্রি-একলাম্পসিয়া নানা সমস্যা দেখা যায়। এ সমস্ত ঝুঁকি যাদের থাকে, তাদের আমরা মনে করি, ওই সময়টায় ডায়াবেটিস ছিল। হয়তো তখন ধরা পড়েনি।
দেখা গেল হয়তো বাচ্চাটা আর বেঁচে নেই বা বেঁচে থাকতে পারলো না। কাজেই আমরা রোগীদের সবসময় বলি যে, আপনরা যেটা প্রি-প্রেগনেন্সি কাউসিলিং একটা কথা আছে; সেটা হলো যে, যদি কোন মহিলা মনে করেন যে, তিনি গর্ভধারণ বা প্রেগনেন্সি নিতে চান, তাহলে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের কাছে আসতে হবে।
বিশেষত যদি তার ডায়াবেটিস থাকে, আর ডায়াবেটিস না থাকলেও, ডাক্তারের কাছে আসলে ভাল। আগের থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যাবে যে, তার ডায়াবেটিস আছে কি-না। থাকলেও কি অবস্থায় আছে। কন্ট্রোলে আছে কি-না। কারণ, দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিস যদি কন্ট্রোলে থাকে তাহলে কিন্তু একজন মহিলার একদম সুস্থ বাচ্চা হতে পারে, এবং তার কোনরকম জটিলতা দেখা যায় না। কাজেই ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করাটাই হচ্ছে আমাদের আজকের মুল উপাদান। কাজেই যখনই প্রয়োজন প্রি-প্রেগনেন্সি কাউসিলিং এর কোন বিকল্প নেই। গর্ভাবস্থার পূর্বে তার সচেতনতা, তার ডাক্তারদের কাছে আসা এবং ডাক্তার সবকিছু পরীক্ষা করে বলবে যে, হ্যাঁ, সে এখন বাচ্চা নিতে পারে। এটা গেল একটা অবস্থা।
তার যদি গর্ভাবস্থা হয়েই যায়, তখন আমরা কি করবো? তখন কিন্তু আমরা তাকে কিছু উপদেশ দেই। একটা হলো, তার ঘনঘন ডাক্তারের কাছে আসতে হবে। এমনিতে রোগীদের আমরা উপদেশ দেই যে, তার পুরো গর্ভবস্থায় অন্তত চার বার ডাক্তারের কাছে আসা উচিত। কিন্তু এসমস্ত রোগীদের অনেক সময় ছয়বার বা আটবার আসতে হতে পারে। কারণ এসময় ডায়াবেটিস থাকলে, জটিলতাটা অনেক বেশি দেখা যায়।
আমরা প্রথমেই ডায়াবেটিস ধরা পড়লে দেখি যে, তার ডায়াবেটিস কতটা আছে। প্রথমেই তাকে একটা খাদ্য তালিকা দেয়া হয়। খাদ্যতালিকা দেয়ার এক সপ্তাহ পরে আমরা আবার টেস্ট করে দেখি। যদি দেখি যে, খাদ্য তালিকায় খাদ্য নিয়ন্ত্রন করে ডায়াবেটিস কন্ট্রলে আছে তাহলে আমরা তাকে সেভাবেই অ্যাডভাইজ করি যে, সে রেগুলার চেকআপ করাবে এবং এভাবেই তার খাদ্য তালিকা মেইনটেইন করবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, খাদ্য তালিকা মেইনটেইন করেও একসপ্তাহ পরে তার ডায়াবেটিস অনেক বেশি। তখন আমরা তাকে ইনসুলিন দেই। সাধারণত আমরা পছন্দ করি ইনসুলিন দিতেই। কারণ ইনসুলিন মা এবং বাচ্চা দুজনের জন্যই সেইফ বা নিরাপদ।
কাজেই তাকে আমরা প্রথমেই আমরা অল্প মাত্রায় ইনসুলিন দিয়ে দেখি যে ইনসুলিনে কন্ট্রল হচ্ছে কি-না। অনেক সময় তিন দিন পর পর তাকে পরীক্ষা করতে হয়। অথবা যখন তার ডায়াবেটিস কন্ট্রোল থাকে, তখন অনেক সময় আমরা কিন্তু তাকে এক সপ্তাহ অথবা দুই সপ্তাহ পরে ডায়াবেটিস বা রক্তের সুগার পরীক্ষা করাই। কিন্তু সবসময় মনে রাখতে হবে যে, নিয়মিত ডাক্তারের কাছে আসতে হবে এবং ইনসুলিন নেয়াটা রেগুলার নিতে হবে। তার ব্লাড সুগার বা রক্তের শর্করাটা মাপতে হবে। এখানে একটা জিনিস আমরা বুঝি যে, অনেক সময় রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসার আগে খুব বেশি কন্ট্রোল করে আসে। দেখা যায় যে তার ব্লাড সুগার বা রক্তের শর্করা একেবারেই স্বাভাবিক। সে জন্য আমরা একটা টেস্ট করি, হিমোগ্লোবিন অ১ঈ। এই হিমোগ্লোবিন অ১ঈ করলে বুঝা যায়, গত তিন মাসে রোগীর কি রকম ব্লাড সুগার ছিল। কাজেই এটা একটা ব্যবস্থা। এছাড়া আমরা এতক্ষণ যেটা বললাম, খাদ্যের নিয়ন্ত্রন সেটা হচ্ছে, মেডিকেল নিউট্রেশন থেরাপী গঘঞ।
এছাড়া তাকে আমরা একটা খাদ্য তালিকা ঠিক করে দেই রোগীর ওজন অনুযায়ী। সে কয়বার খাবে। ডায়াবেটিসে কিন্তু একটু ঘনঘন খেতে হয়। মেইন খাবার যেটা সেটা তিন বেলা খাবে আর এছাড়াও তিনবেলা স্ন্যাকস্ খেতে হয়। এমনকি ঘুমের আগেও তাকে একটা হালকা খাবার খেতে হয়। যাতে তার হাইপো না হয়। হাইপো মানে হলো, রক্তের সুগারটা কমে যাওয়া। কারণ হাইপো হলে যেটা হয়, বাচ্চা ও মা দুইজনেরই মারাত্মক অবস্থা হয়। কাজেই আমরা তাদের সচেতন করে দেই। তারপর তাদের আমরা একটু হাটাহাটি করতে বলি। হালকা ব্যায়াম করতে পারে সে। এবং তার অন্যান্য যে ওষুধ যেমন আয়রন, ক্যালশিয়াম এগুলো তার রেগুলার খেতে হবে। এবং ঘনঘন ডাক্তারের কাছে আসার কথা আমরা এজন্য বলি, যে তার বাচ্চার কোনো অসুবিধা আছে কি-না। একটা হলো যে, এসমস্ত রোগীদের গর্ভপাত বেশি হয়। কাজেই গর্ভপাত যাতে না হয় তাই আগে থেকেই তাকে চিকিৎসা দেই।
দেখা যায় যে, রোগীর পেটে বাচ্চাটারও অনেক ওজন হয়ে গেছে। যেটাকে আমরা বলি, ম্যাক্রোসোমিয়া। সুস্থ, নাদুসনুদুস বাচ্চা দেখতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু সেটা যদি ডায়াবেটিসের কারণে হয়, তাহলে কিন্তু সেটা ভালো না। কাজেই বাচ্চার ওজনও যাতে নিয়ন্ত্রনে থাকে, সেজন্য আমরা চিকিৎসা দেই। এছাড়াও মাঝে মাঝে তার ইউরিন পরীক্ষা করতে হয় এবং তাদের ব্লাড প্রেসারটা যেন বেশি না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় যে, প্রি-এক্লামশিয়া অথবা এক্লামশিয়া এই সময় বেশি হতে পারে। এখন এই সমস্ত রোগীদের ব্যাপারে একটা কথা হলো যে, অনেক সময় রোগীর ব্লাড সুগারটা কন্ট্রোলে না থাকে তখন, আমরা ৩৭ সপ্তাহ হয়ে গেলে পরে, যদি বাচ্চার ওজন ২.৫ কেজির উপরে হয়ে যায়, তখন আমরা বাচ্চাকে ডেলিভারী করিয়ে দিই। কারণ এই শেষের দিকে, অনেক সময়, বাচ্চা পেটের মধ্যে মারা যেতে পারে। যদি ডায়াবেটিসটা কন্ট্রোলে না থাকে। আর যদি ডায়াবেটিস খুব চমৎকার কন্ট্রোলে থাকে, তাকে ইনসুলিন নিতে দেয়া হয়। তাহলে সে চল্লিশ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে। স্বাভাবিক ডেলিভারী অবশ্যই হতে পারে।
লেখক:
অধ্যাপক মেজর (অব.) ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু
চিফ কনসালটেন্ট, অবস্ অ্যান্ড গাইনি, ল্যাবএইড, ঢাকা।